বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ৭


বাসুন,

আমার প্রিয় দেশটা বন্যায় ভেসে যাচ্ছে রে, কি হাহাকার মানুষের ভিতর । গত তিনদিন হলো তুই আর আমি টানা বাড়িতে আছি । কিছুক্ষন পর পর বিবিসি ছাড়লেই দেশটাকে দেখতে পাচ্ছি । কি নিদারুন কষ্টে আছে গোটা দেশ আর দেশের মানুষগুলো, কি করবো বল ? এত দূর থেকে কি বা করতে পারি আমরা, কতটুকুই বা সাধ্য আমাদের । বুকের ভিতরটা যেন দুমড়ে যাচ্ছে প্রতিমুহুর্ত ।  এইতো মাত্র ২০০৪ সালে আমি তখন বাংলাদেশে ব্র্যাক এ কাজ করতাম । বন্যার ভয়াভয় চিত্র স্বচক্ষে দেখার জন্য আমরাও ছুটে গিয়োছলাম দেশের প্রtYÇ» এলাকগুলোতে । তেমনি এক অভি¯তার কথা লিখেছিলাম দৈনিক প্রথম আলোতে।  লেখাটা তোকে পড়ে শোনাই বাসুন, তাহলেই বুঝতে পারবি কি র্দুভাগা একটা দেশে বাস আমাদের।

সাম্প্রতিক বন্যা ও ছকিতন

ছকিতনের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী থানার ফুলবাড়ি ইউনিয়নে। ওর একটা পা সামান্য খোড়া, সঙ্গে দুই ছেলে, ভাগ্য ভালো ছকিতনের মেয়ে নেই।এই ঢাকা শহরে যারা আজকের পত্রিকায় ছকিতনের গল্প পড়ছেন তারা অনেকেই ধারনা করতে পারবেন না যে, কত সামান্য উপকরন নিয়ে ছকিতন তার জীবনের ৩৬ বছর পার করেছে। যথারীতি বিয়ের দুবছর পর স্বামী ছেড়ে গেলে ছকি তার বোনের ছাউনির পাশে আশ্রয় নেয়, মাটির দুটো শানকি, একটা তেল চিটচিটে কাথা, কয়েকটা ছড়ানো ছিটানো এলোমেলো দ্রব্য নিয়ে ছকিতনের খোলা আকাশের নীচে বাস ।

ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো কাজে কাজেই, ছোট একটা কেস লেখবার দায়িত্ব ছিলো আমার, এবং তাতেই ছকির সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই আমি। জানতে পারি আরো কিছু তথ্য যেমন, স্বামীর কাছে খুব মার খেতো ছকি, স্বামী অন্য জায়গায় বিয়ে করেও ছকির কাছে টাকার জন্য জুলুম করতো, এবং শেষে ছেড়ে যাবার হুমকি দিতো। এসব গল্প বলার সময় ছকির মধ্যে কোন উত্তাপ লক্ষ্য করিনি আমি, কারন যার হারাবার কিছু নেই তারতো প্রাপ্তিরও কিছু নেই । তাই বহু বি¯ দার্শনিকের মতো ছকি নিমোর্হ ভাবে কথা বলতে পারতো।

উপরের গল্পটা ছিলো প্রায় বছর দুয়েক আগের চিত্র। হঠাআবার ছকির কাছে যাবার সুযোগ হয় আমার। ছকির কাছে রওনা দিয়ে পথে আমার নানান কথা মনে হতে থাকে, মনে হয় ছকির সাথে আমাদের দুরত্ব কোনদিন ঘুচবে না, আবার যদি ঘুচেই যায় তবে আর আমার কাজ কি থাকল, ডোনারকে কোন প্রোভার্টি লেভেল বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্টি আমরা দেখাবো, টাকা আনতে হবে না? নইলে চাকরির নিশ্চয়তা কি, এসব তো আমাদেরই সৃষ্টি। তাই ঢাকায় বসে আমি যখন জানতে পারি বা আমাকে জানানো হয় যে, গিয়ে দেখে আসুন ছকিতনের জীবন, একবারে বদলে গেছে। ওর উপর অবার নতুন স্টোরী লিখতে হবে আপনাকে, তখনো আমার মনে আত্ববিশ্বাস থাকে যে যাই বলুক কতটুকু আর এগোবে ছকি । যতটুকু আমরা চাইবো ততটুকুইতো । তবে আর ভাবনা কি, ধরলা নদীর পাড়, অবিরাম বর্ষা, এবং গাড়ির ভিতর বিদেশী মগে কফি আমার মধ্যে কাব্য তৈরী করে। আমি অন্য কিছু ভাবতে থাকি। হঠা গাড়ির ব্রেক আমার ভাবনার জালকে ছিন্ন করে, একি রাস্তার মাঝে গাড়ি থামানো কেন ? সহর্কমী বলে উঠেন, আপা মাত্র গতরাতের বন্যায় ভেসে গেছে নাগেশ্বরী, ভেবেছিলাম কোন উচু জায়গায় ছকি হয়তো আশ্রয় নিয়েছে তাই আপনাকে দেখাবো কিন্তু দেখুন যতদুর চোখ যায় সবই পানি আর ওখানেই তো ছকির বাড়ি ছিলো, এবছর আমরা ওকে ৬টা ছাগল দিয়েছিলাম, আপা বিশ্বাস করেন ছকি বেশ উন্নতিও করেছিলো কিন্তু এই বন্যায় মনে হয় সব আবার সব ভেসে গেছে । প্রোগাম আবার শুরু করতে হবে। সহকর্মীর গলায় বেদনা থাকলেও ভয় নেই বরং অনেক বেশী উদ্যম।

আবার নতুন উদ্যম, নতুন পিপি(প্রোজেক্ট প্রোপজাল), গত ৩৫ বছরের সাধনা, দরিদ্র ব্যবসা আজকে বাংলাদেশে সবচেয়ে লাভজনক, আরো চাকরির নিশচয়তা, এই বন্যায় কি নতুন কোন রোগ আসবে তাহলে আরো কিছু সেমিনার, আবার পাইলট করা, আবার বেসলাইন সার্ভে, কত কাজ, অবশ্য সবই কমপিউটারের পুরোনো ফাইলে আছে কেবল আরো একটু সুন্দর করে উপস্থাপন করা, সামনে বাবুর স্কুল বদলের টাকাটা অবশ্যই জোগাড় হতে হবে, যা হোক বন্যায় কাজগুলো প্রায় ঠিক হয়েই রইল। কখন গাড়িতে উঠেছি কখন কুড়িগ্রামে পৌছেছি আমার ঠিক খেয়াল নেই ।

লুনা শীরিন
উন্নয়ন কর্মী, ধানমন্ডি ঢাকা ।
(প্রথম আলো , ২১.০৭.০৪)

বিশ্বাস কর বাবু দেশকে নিয়ে এমন উপহাস করতে ইচ্ছে করে না,  কিছুতেই না,  কিন্তু আজ প্রায় তিনবছর পর দেশের বন্যা পরিস্থিতি ভেবে বার বার অতীতের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে ।  আমার সেই ছকিতনরা কি আবার নতুন কোন প্রতারনার জালে আটকা পড়ছে? ভীষন জানতে ইচ্ছে করছে যে অসহায় মানুষ কিভাবে সময় পার করছে ।  প্রার্থনা করা ছাড়া আর কিইবা করার আছে আমাদের ।

তোর মা
অগাষ্ট, ২০০৭
                                                                                               Email:[email protected]

পর্ব                                                                                   পর্ব