বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ৮

বাসুন,

সেদিন কথাটা বলছিলো তোর সেরীন খালা, কানাডাতে নাকি আগামী কয়েক বছরের ভিতর আরো অনেক বেশী মানুষ লাগবে দেশটাকে সচল রাখার জন্য । ২০১০ সালে এই দেশের বেশ বড় অংশ নাগরিক রিটায়ারমেন্ট এ চলে যাবে, তাই এখনকার চাইল্ডট্যাক্স বেনিফিটের চেয়ে সেইসময়ে তা দিগুন দেয়া হবে । কারন, সাদা কানাডিয়ানদের ভিতর জন্মহার দুই এরও কম। কানাডায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির তারতম্য নির্ভর করছে তাই ইমিগ্র্যান্টদের উপর । এই খবর প্রচার হবার পর এই শহরের সাউথ এশিয়ানরা নাকি কোমর বেধে নামছে আরো বাচ্চা কাচ্চা নেবার জন্য । যারা বাচ্চা নিয়ে এই দেশের নাগরিক হয়ে বসবাস করছে বা করতে চায় চায় তাদের জন্য খবরটা নিশ্চয়ই সুখের ও আনন্দের। সেদিন তোর বন্ধু ইশমামরা গিয়েছিলো আমেরিকার একটি পাহাড়ে লং উইকএন্ড কাটাতে। ফিরে এসে বলল, পাহাড়টা নাকি আয়তনে বাংলাদেশের চেয়েও বড়। আসলে কি জানিস সোনা, তোকে এসব গল্প বলে কোন লাভ নেই কারন। কিছু বিযয় থাকে যা নিজে উপলব্ধি না করলে কোনদিন বুঝতে পারা যায় না। বাংলাদেশ থেকে কানাডা আসার আগে আমি কোনদিন বুঝতে পারিনি, কেন বিদেশী বাংগালীরা দেশ দেশ করে পাগল হয়ে থাকে। কেন শুধু দেশের সাথে বিদেশের তুলনা করে, আর কষ্ট পায় । যাকগে, তুই যদি এইসব দেশেই বড় হোস আর পড়াশুনা করিস, তাহলে দেখবি এরাও ধর্ম চর্চা ker। বরং অনেক ক্ষেত্রেই আমেদের চেয়ে বেশীই মানে ও s‡ থাকে। শুধু আমাদের মতো ধর্মীয় গোড়ামীটা ওদের নেই । আজো ছুটির দিন, সারাদিন ইন্টানেট এ বসে বসে ভাবি আর কিছুক্ষন পরে পরে গিয়ে তোকে আদর করে আসি, তাই না রে বাবু । তুই যদি বড় হযে আমার চিঠিগুলো পড়িস তাহলে দেখবি কত ধরনের চিন্তা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখতো এই সময়। বাংলাদেশের সাধারন মানুষের ভিতর সন্তান নিয়ে একটা সত্যি গল্প তোকে আজ বলছি, শোন।

(মর্জিনার কথা)

বৃহত্তর নীলফামারী জেলার কিশোরীগঞ্জ থানার এই কাহিনীতে বনির্ত হয়েছে জীবনের খুব সাধারন কথা। জীবনধর্মী এই কাহিনীর নির্জাস তৈরী হয়েছে মর্জিনা নামী পঞ্চাশ উর্দ্ধ এক মহিলার জীবন থেকে। মর্জিনার পুরো নাম মর্জিনা বেগম ওরফে মর্জি, স্বামী আজিমুর রহমান কৃষি কাজ করে। মোট আট
sÇ»aenr জননী মর্জিনার ছয় ছেলে দুই মেয়ে। AàTa‡ পরিবারে দশটি মুখের খাবার জোগাড় করতে হয় মর্জিনাকে একা। তবুও মজিনা নির্বিকার। গত পয়ত্রিশ বছর ধরে sÇ»an জন্ম দিতে দিতে ওর শরীর ভেংগে গেছে কিন্তু এই বিযয়ে মর্জিনার অবস্থান খুব দৃঢ় ।

মুলত, মর্জিনার বাবা ছিলেন একজন মৌলভী সাহেব । তিনি মসজিদে আজান দিতেন এবং ধর্মের জন্য মানুষকে নসিহত করতেন । বাবার সংসারে মর্জিনা বড় মেয়ে, বাবা তাকে বিয়ে দেয় ১২ বছর বয়সে । বিয়ের দিন বাবা তার মাথায় হাত দিয়ে বলেন যে “ মাগো সংসার জীবনে
sÇ»an হচেছ আল্লার নিয়ামত, এই sÇ»an বন্ধ করার জন্য কখনো কোন ব্যবস্থা নিবা না । তাহলে আল্লার গজব নাজিল হবে । এটা তোমার প্রতি আমার নির্দেশ। ”

মর্জিনা তার সংসার জীবনের দীর্ঘ সময় এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে । অপরিসীম দারিদ্র্য আর ক্ষুধার মধ্যেও মর্জিনা আটটি
sÇ»an জন্ম দিয়েছে । আজ মর্জিনা জানেও না যে তার শারীরিক অপুষ্টি আর অস্বাস্থ্যর জন্য জন্ম নিয়েছে তিন তিনটি বিকলাংগ sÇ»an। তারা এখন মজিনার সংসারে বোঝা । খুব সম্প্র্রতি পাড়া প্রতিবেশীর কথাবার্তা থেকে সে জানতে পেরেছে যে, “ পরিবার পরিকল্পনা করে মানুষ এখন অনেক কম বাচচা নিতে পারে তাতে সংসার ছোট হয় এবং সুখের হয়।” ikǼ মর্জিনার জীবনে পথরোধ করে দাড়িয়ে আছে তার মৃত্যু পথযাত্রী বাবা সেই নির্দেশ। এই নির্দেশ অমান্য করা মানে আল্লার মতের বাইরে যাওয়া। আরো ˆeLK করা প্রয়োজন, মজিনার স্বামী অর্কমন্য হয়ে গেছে তাও প্রায় বছর তিনেক হতে চলল। দুমেয়ের বিয়ে দিয়েছে সে কিন্তু সেখানেও নানান জটিলতা। বড়ছেলে বিয়ে করে আলাদা খায়, সংসারে কোন টাকা পয়সা দেয় না । ৫ সন্তান এক স্বামী সহ মোট সাত জনের খাবার যোগান দিতে মর্জিনার জীবন কন্ঠাগত, কিন্তু অন্য কোন পথও খোলা নেই ওর সামনে ।

কিশোরীগঞ্জ থানার ফরুয়াপাড়া গ্রামের মর্জিনার জীবনে কোন
ˆ¾an
-পতন নেই । এ যেন ভারী পাথরের মতো বয়ে চলা এক জীবন ।

(২০০২ , নিলফামারী , রংপুর)

বাবু, আমি কানাডা আসার পর সবচেয়ে মনোযোগ এবং ভালোবাসা দিয়ে যেই কাজটা করেছি তা হলো এইদেশের মানুষের জীবন যাপনের প্রনালী, চিন্তা চেতনা, ধর্মীয় মুল্যবোধ ইত্যাদি গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা । আমার মনে হয়েছে জাতি হিসেবে আমরা বাংলাদেশীরা কয়েকশো যুগ পিছিয়ে আছি । কারন, যে দেশের মানুষ জানে না সে কেন একটি সন্তানকে পৃথিবীতে আনছে আর কিই বা সেই সন্তানের
BibxY‡, কোথায় জায়গা হবে এই নতুন শিশুর। সেই দেশ আগামী কতদিনে আলোর মুখ দেখবে তা শুধুমাত্র প্রকৃতি ছাড়া আর কে বলবে বল বাসুন? সেদিন আমার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ফোনে বলছিলো যে, তোর লেখা এই ধারাবাহিকটা পড়লে নাকি মনে হয় তুই শারীরিকভাবেই শুধু কানাডাতে বাস করছিস, তোর মনটা পড়ে থাকে দেশে। কি করবো বল বাবু? আমি কি চাইলেই বদলাতে পারি নিজেকে? আমার পিছনে ফেলে আসা সময়গুলো যে আমাকে স্থির হয়ে থাকতে দেয় না একমুহুর্ত। ভালো থাক বাবু।

তোর মা
১১ অগাষ্ট, ২০০৭
                                                                                            Email:[email protected]

পর্ব                                                                                   পর্ব