উত্তর রনাঙ্গন ৭১:
অপারেশন পানিহাতা টু জামালপুর
মোঃ রহমতুল্লাহ
কোম্পানী কমান্ডার, ১১ নং সেক্টর ,১৯৭১।
সারারাত ঘুম জাগা তাই দুপুরের খানা খেয়ে সকলকেই বিশ্রাম করতে আদেশ দিয়েছি। যারা রান্নার কাজে দায়িত্বে আছে তারা রান্না করছে। হঠাত্ বাঁশীর হুইসেলে ,সকলেই হতবাক। অফিসার জানাল ,সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাকে প্রস্তুত করতে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সকলেই সসস্ত্র প্রস্তুত হলাম। তিনি আমাদেরকে ডালো বারাঙ্গা পাড়া মিত্র বাহিনীর ঘাটিতে যেতে বললেন। রাতের জন্য রান্না বান্না প্রায় শেষ। অনেকে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু সবকিছু ফেলে সকল মুক্তিযোদ্ধা রওয়ানা হলাম। মনে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই; পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা , তবুও আনন্দ, সম্মূখযুদ্ধে যাচ্ছি। দেশ স্বাধীন হবে। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী মুক্ত দেশে শান্তিতে থাকবে। এই বুক ভরা আশা নিয়ে স্বদেশের মাটির দিকে দ্রুত যেতে থাকলাম। ডালো বারাঙ্গা পাড়ায় কিছু আনুষ্ঠানিকতার পর বাউরামারী হয়ে নন্নী পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা। আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাউরামারী নন্নী হয়ে প্রথমে ঝিনাইগাতীর আহম্মদ নগর পাক বাহিনীর ঘাটি আক্রমন করার ।শেরপুরের পথে নন্নীতে আমার ছোট বোন রৌশন আরার বাড়ী। বোনসহ এলাকার মুক্তিপাগল মানুষের কি আনন্দ-মুক্তিবাহিনী এসেছে। রৌশন আরা আমাকে সমস্ত যোদ্ধার সামনে দেখে চিনে ফেললো, অশ্র“ সজল নয়নে শুধু বল্লো-সকলেই একটু দাঁড়াও। ২/৩ মিনিটের মধ্যেই বস্তায় বস্তায় চিড়ামুড়ি-গুর নিয়ে আমাদের কে বিতরণ করলো। খাবার এর পর আবার চলতে শুরু করলাম। আমাদের যেতে হবে ঝিনাইগাতী হয়ে শেরপুর। রাত ৮ ঘটিকায় ঝিনাইগাতী পৌছলাম। হঠাত্ মোবারক ও প্লাটুন কমান্ডার বকর নামে দু'জন সহযোদ্ধা আমাকে অনুরোধ করে বলল-স্যার এখান থেকে অতি নিকটে আমাদের বাড়ী। আপনার নিকট অনুরোধ, মাত্র ১০ মিনিটের জন্য সকলকেই নিয়ে আমাদের বাড়ীতে চলুন ,সময়মত শেরপুর পৌছতে কোন অসুবিধে হবে না। আমরা মোবারকের বাড়ী কালিনগর গেলাম। মোবারকের পিতামাতা আত্মীয় স্বজনসহ গ্রামের লোকদের কি আনন্দ। আমাকে না জানিয়ে না বুঝতে দিয়ে বিরাট বড় একটা ষাড় গরু জবাই করে ফেললো। চারিদিকে রান্না শুরু হলো। রাত ২ টার মধ্যেই খানা-পিনা শেষ করে আবার রওয়ানা হলাম শেরপুর সদরের দিকে। পথে আহাম্মদ নগর পাক বাহিনীর শক্ত ঘাটি। আমরা পৌঁছার আগেই হানাদার পাক বাহিনী ঘাটি ছেড়ে চলে গেছে। এই ঘাটিতেই শত শত স্বাধীনতাকামী লোকদেরকে এনে ক্রস ফায়ারে হত্যা করেছে।ভোর বেলায় আহম্মদনগর ক্যাম্প রেড করে শেরপুর সদরে আসার পথে আল বদর কমান্ডার কামরুজ্জামান (ভারতে থাকতেই শুনেছি , জামাতে ইসলামীর শেরপুরের নায়েবে আমির ফজলুর রহমান কামরুজামানকে দিয়ে অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছেন এবং শেরপুর পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে আওয়ামী লীগের নেতা সমর্থকদের হত্যার পরামর্শ দিয়ে লিখিত তালিকা পেশ করেছিলেন ) এর বাড়ী ঘেরাও করলাম কিন্তু তাকে পেলাম না। জানতে পারলাম আগের রাতে আহম্মদনগর ক্যাম্পের পাক বাহিনীদের সাথে জামালপুরে চলে গেছে । সকাল ৭ঘটিকায় শেরপুর শহরে পৌঁছালাম। শেরপুর শহরেই আমাদের বাড়ী। খবর পেয়ে শ্রদ্ধেয় বাবাজান দারগ আলী পার্কে আসলেন। একে একে সকলের সাথে দেখা হলো। মা আমাকে দেখে আবেগে বিহব্বল হয়ে প্রায় বাকশূন্য হলেন। শুধু দেখা হলো না স্ত্রী নূরজাহানের সাথে। সে তখন তাদের গ্রামের বাড়ীতে ছিল।হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের আনন্দ দেখে আমি আবেগের কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। কিছুণের মধ্যেই হেলিকপ্টার আসলো। পদার্পণ করলেন মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেঃ জেঃ আরোবা। আমার বাহিনীসহ হাজার হাজার মুক্তি বাহিনী ও মুক্তি পাগল মানুষ তাকে অভ্যর্থনা জানালাম। মুহুর্তেই আদেশ হলো আজ বিকাল ৫ ঘটিকায় জামালপুর আক্রমণ করতে হবে। জামালপুর এম্বোসের জন্য আমার বাহিনীকে নান্দিনায় ডিফেন্স দেওয়া হলো-যাতে হানাদার বাহিনী রেলওয়ে যুগে পালাতে না পারে।
জামালপুর মুক্ত করে কামাল খান মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আলবদর বাহিনীর প্রধান বহু মানুষ হত্যাকারী, ধনসম্পদ লুটকারী আব্দুল্লাহ ইবনে ফজলের (ফজল মুন্সী , বর্তমানে বোমাবাজ কথিত শায়খ আবদুর রহমানের পিতা) বাড়ী ও মাদ্রাসা ঘেরাও করলাম। তিনি পলাতক। লুটের মাল উদ্ধার করে জামালপুরের এস ডি ও এর হেফাজতে দিলাম। আমাকে এস ডি ও সাহেব প্রশংসা করলেন এবং মাল্য দান করলেন।
এভাবে ৪ঠা ডিসেম্বর পানিহাতা, নালিতাবাড়ী, ৫ই ডিসেম্বর বাওরামারী, ঝিনাইগাতী, ৬ই ডিসেম্বর শেরপুর, ৭ই ডিসেম্বর জামালপুর, ময়মনসিংহ, মধুপুর শত্র“ মুক্ত হলো। ইতিপূর্বেই কাদের সিদ্দিকি টাঙ্গাইল মুক্ত করেছে। ১৬ই ডিসেম্বর ৯০,০০০ হাজার হানাদার বাহিনীর আত্মসর্মনের মধ্য দিয়ে বাংলার মাটিতে উড়ল বিজিয়ের নিশান ।জয় বাংলা ।
(লেখক পরিচিতি : জন্ম :১৯ ফেব্রু ১৯৪৩ ,শেরপুর । তিনি ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টম্বর শেরপুরে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রির্পোর্ট বাতিল আন্দোলনে সে সময়ের " শেরপুর জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি" হিসেবে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরোদ্ধে বিশাল জনসমাবেশে গণন্দোলোনের ডাক দেবার জন্য গ্রেফতার ,চরম পুলিশী নির্যাতনের শিকার ও কারাজীবনশুরু এবং ১৯৬৩ সালের ১৫ মার্চ কারামুক্তি লাভ। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু লাহোরে বাঙ্গালির মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষনা ও তার বাস্তবায়নের দাবি আন্দ্দোলনের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু সহ সারাদেশে ব্যাপকহারে গ্রেফতার অভিযানের প্রেক্ষিতে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা জনাব রহমতুল্লাহ পুনরায় গ্রেফতার হন এবং ১৯৬৯ এর গন অভ্যুত্থানে কারাবরন করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন শেরপুর আওয়ামী লীগ এর যগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং শহর কমিটির সাধারণ সম্পাদক। উত্তাল মার্চ '৭১ এ মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের দায়িত্বপালন এবং পরবর্তিতে ভারতে ট্রেনিং নিয়ে ১১ নং সেক্টরে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি বৃহত্তর ময়মনশিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে প্রথমে গেরিলা , পরে সরাসরি সম্মুখ সমরে অংশ নেন। উল্লেখযোগ্য হল :কামালপুর অপারেশন যেখানে সেক্টর কমান্ডার ক্যাঃ তাহের ও রহমতুল্লাহ কোম্পানিসহ মুক্তিবাহিনীর একাধিক কোম্পানি , মেজর জিয়া'র নেতৃত্বে জেড ফোর্স এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনী অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধকালে পাক সরকার তাকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দেবার জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষনা করে। উল্লেখ্য, শেরপুর শত্রুমুক্ত হয় ডিসেম্বর ৬ তারিখে এবং যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল অরোরা কে মুক্তাঞ্চলে তিনি ই অভর্থনা জানান এবং নির্দেশ মোতাবেক পরদিন জামালপুর পাক হানাদার মুক্ত করার জন্য নান্দিনায় এম্বুস করেন । ১৯৭২ সানে ২২ ফেব্রুয়ারী তৎকালীন মিত্রবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় অধিনায়ক জেনারেল নাগরাকে ময়মনসংহ সার্কিট হাউজে তার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর সংবর্ধনাদান করা হয়। ১৯৭২ সানে ২৮ ফেব্রুয়ারী তিনি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি (সি এন সি) জেনারেল ওসমানীর স্বাক্ষরিত "স্বাধিনতা সংগ্রামের সনদপত্র" মুক্তিযোদ্ধাদের বিতরনপুর্বক নিজ নিজ কর্মে যোগদানের নির্দেশ দিয়ে ময়মনসংহ (খাগডর বি ডি আর )মাঠে ভাষনদান করেন। ১৯৭৪ সালে রক্ষীবাহিনীর নানা কর্মকান্ড ও অত্যাচার কে কেন্দ্র করে পার্টির সাথে মতবিরোধ এর প্রেক্ষিতে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহন করেন । )