স্বাধীনতার নেপথ্যের ইতিহাসঃ আমরা যাদের ভুলে গেছি -৪
নুরুজ্জামান মানিক
("বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ" দর্শনে বিশ্বাসীদের ২৬শে মার্চ ৭১ পূর্ববর্তী বাংলাদেশ কে স্বাধীন করার যে কোন উদ্যোগকে অস্বীকার করার কারণ বোধগম্য কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্ট আওয়ামী লীগ প্রায় ৪০ বছর পরেও যখন তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে সশস্ত্র উপায়ে বাংলাদেশ কে স্বাধীন করার প্রথম উদ্যোগকে মিথ্যা হিসেবে বর্ণনা করে তখন আমাদের আর গতি থাকে না।)
সশস্ত্র উপায়ে বাংলাদেশ কে স্বাধীন করার প্রথম উদ্যোক্তা ছিলেন তত্্কালীন নৌ বাহিনীর লে কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন । বেঙ্গল রেজিমেন্ট, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর কতিপয় দুঃসাহসী তরুন সদস্য এবং কয়েকজন প্রভাবশালী বাঙ্গালী আমলার সহায়তায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান কে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা করেন। সামরিক ও প্রশাসন ক্ষেত্রে বাঙ্গালীদের প্রতি পাকিস্তানী /পাঞ্জাবীদের বিজাতীয় শাসন-শোষন অবহেলা প্রত্যক্ষ ভুক্তভুগি ছিলেন তারা। দুর্ভাগ্য হল, তাদের এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়।
উল্লেখ্য, কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন যাদের সাথে আলোচনা করতেন এবং তার পরিকল্পনার পক্ষপাতী মনে করতেন তাদের নাম ডায়রীতে লিখে রাখতেন। ইতিমধ্যে নৌ বাহিনীর কর্মী ষ্টুয়ার্ড মুজিব সদর দপ্তর থেকে পালিয়ে পুর্ব বাংলায় আসে এবং চট্রগ্রামের ডি সি খান শামসুর রহমান সাথে দেখা করে বলে , সে খুব বিপদের মধ্যে আছে, তার বিরোদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে তাই তার বাড়ী ফরিদপুরে যেতে পারছে না । আপনি যদি দয়া করে ফরিদপুরের ডি সি কে একটা চিঠি লিখে দেন তবে আমি বাড়ি গিয়ে টাকা পয়সার ব্যবস্থা করতে পারি । শামসুর রহমান একটা ছোট চিঠি লিখে ষ্টুয়ার্ড মুজিব এর হাতে দেন যাতে লেখা ছিল যে, ষ্টুয়ার্ড মুজিব তার সাথে দেখা করে তার অসুবিধার কথা বলবে এবং সম্ভব হলে যেন তাকে সাহায্য করেন । চিঠিটি পাঠমাত্র ছিড়ে ফেলার নির্দেশ ছিল । ঐ চিঠি নিয়ে ষ্টুয়ার্ড মুজিব ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক এম এস রহমানের সাথে দেখা করে এবং চিঠিটি তার হাতে দেন । এম এস রহমান চিঠিটি ছিড়ে ফেলে দেন।
১৯৬৮ সালের ৬ ই জানুয়ারী ২ জন বাঙ্গালী সি এস পি অফিসারসহ ১৮ জন সামরিক/বেসামরিক বাঙ্গালী আফিসারকে গ্রেফতার করা হয়। সরকারী প্রেসনোটে বলা হয়, "গ্রেফতারকৃতরা ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে সশস্ত্রপন্থায় পূর্ব পাকিস্তাঙ্কে আলাদা করার চক্রান্ত করছিল।"
১৭ ই জানুয়ারী রাতে হঠাত্ করে কে মুক্তি দেয়া হয় ৮-০৫-৬৬ তারিখ থেকে ৬ দফা আন্দোলনের জন্য কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমান কে । জেল গেট থেকে বেরিয়ে কয়েক পা এগুতেই সামারিক বাহিনীর সদস্যরা তাকে পুনরায় গ্রেফতার করে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। ১৮ জানুয়ারী সরকারী প্রেসনোটে বলা হয়, "শেখ মুজিব একটি ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী ।" এই মামলাটিই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বলে খ্যাত। আসামী ৩৫ জন। রাজসাক্ষী ১১ জন।
২১ শে এপ্রিল প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এক অর্ডিনেন্স জারির মাধ্যমে পাকিস্তান পেনাল কোডের ১২১ক এবং ১৩১ ধারায় অপরাধীদের বিচার করার জন্য এক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রধান বিচারপতি এম এ রহমান এবং সদস্য ছিলেন বিচারপতি মুজিবুর রহমান, বিচারপতি মোকসুমুল হাকিম। কুর্মিটোলা সেনানিবাসের সিগন্যাল মেস প্রাঙ্গনে ট্রাইব্যুনাল বিচার শুরু হয় ১৯ জুন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে , এই মামলায় মোট ৩৫ জনকে আসামী করা হয় । শেখ মুজিবুর রহমান, লে কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, ষ্টুয়ার্ড মুজিব, এল এস সুলতানুদ্দিন আহমদ, এল এস সিডি আই নুর মোহম্মদ , আহমদ ফজলুর রহমান সি এস পি, ফ্লা সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ, কর্পৌারাল আবুল বাশার, মোহাম্মদ আবদুস সামাদ, হাবিলদার দলিল উদ্দিন, ফ্লা সার্জেন্ট মোহাম্মদ ফজলুল হক, খন্দকার রুহুল কুদ্দুস সি এস পি, ভুপতি ভুষন চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী, বিধান কৃষ- সেন, সুবেদার আবদুর রাজ্জাক, হাবিলদার ক্লার্ক মুজিবুর রহমান, ফ্লা সার্জেন্ট মুহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক, সার্জেন্ট জহুরুল হক, এটি মোহাম্মদ খুরশীদ, খান শামসুর রহমান সি এস পি, হাবিলদার এ কে এম শামসুল হক, হাবিলদার আজিজুল হক, এস এ সি মাহফুজুল বারী , সার্জেন্ট শামসুল হক, মেজর আবদুল মোতালেব , ক্যাপ্টেন এম শওকত আলী, ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা ( ৭ই নভেম্বর ৭৫ তারিখে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা ) , ক্যাপ্টেন এ এন এম নুরুজ্জামান ( ৭১ এ ৩ নং সেক্টর কমান্ডার , মুজিব আমলে প্যারা মিলিশিয়া রক্ষিবাহিনী প্রধান ) ,সার্জেন্ট আবদুল জলিল , মোহাম্মদ মাহববু উদ্দিন চৌধুরী, ফার্ষ্ট লে এম এম এম রহমান, সুবেদার এ কে এম তাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী রেজা, ক্যাপ্টেন খুরশীদ উদ্দিন আহমদ এবং ফার্ষ্ট লে আবদুর রউফ ।
মামলার ভিত্তি ছিল দুটো দলিল -
১)লে কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ডায়েরী
২) শামসুর রহমান সাহেবের ফরিদপুরের ডি সি কে লেখা চিঠি।কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ডায়েরী কেমন করে সেনা গোয়েন্দা বিভাগের হাতে গেল এবং স্টুয়ার্ড মুজিব কেন শামসুর রহমান সাহেবের ফরিদপুরের ডি সি কে লেখা চিঠির ফটোকপি রেখে ছিল এবং সেটাও কিভাবে সনা গোয়েন্দা বিভাগের হাতে গেল সেটা জানা যায় নি ।
আসামীদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন আবদুস সালাম খান । সরকার পক্ষে ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক পররাস্ট্রমন্ত্রী মনজুর কাদের, গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আসলাম , টি এইচ খান, আবদুল আলীম প্রমুখ । ডাঃ সাইদুর রহমান, চীফ পেটি অফিসার কামাল উদ্দিন আহমদ প্রমুখ রাজসাক্ষী হন।
বংবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন না কিন্তু তাকে ঐ মামলায় জড়ানো হয় তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি টানার উদ্দেশ্যে । পাকিস্তানের শাষকচক্র ভেবেছিলেন , জনগণ যখন জানতে পারবে, শেখ মুজিব ভারতের দালাল হয়ে পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তখন তার বিরোদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়বে কিন্তু পরিনতি হয়েছিল তার ঠিক উলটো । শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা থেকে পরিনত হয়েছিলেন বাঙলীর স্বাধিকার আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা এবং উপাধি পেয়েছিলেন "বংবন্ধু" হিসেবে। (অসমাপ্ত)
P.S: সশস্ত্র উপায়ে বাংলাদেশ কে স্বাধীন করার প্রথম প্রচেস্টার অনেকেই আজ আমাদের মাঝে নেই । হাতে গোনা যারা রয়েছেন তারাও এক সময় চলে যাবেন কালের নিয়মে । সে সাথে হারিয়ে যাবে তাদের উদ্যোগের কথা ।
কথা গুলি বললাম কারন আজ পর্যন্ত তাদের উদ্যোগের কথা অফিসিয়াল্লি বলা হয়নি , পান নি তারা রাস্ত্রীয় সম্মামনা । আজও পত্র পত্রিকায় লেখা হয় "আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা " মিথ্যা ছিল । এই মামলার আসামি মেজর আবদুল মোতালেব বলেছিলেন " এটি ২০০% সত্য ছিল " । কালের অমোঘ নিয়মে মেজর আবদুল মোতালেব আজ আমাদের মাঝে নেই মানে ইতিহাসের এক দলিল হারিয়ে গেল।
এভাবেই হারিয়ে যাবে সব কিছু।