সমকামীতা সম্পর্কিত কিছু ব্যক্তিগত মতামত

স্নিগ্ধা আল

সমকামীতার মতো একটা স্পর্ষকাতর বিষয় নিয়ে  লিখতে বসে ভাবছিলাম কোথা থেকে শুরু করবো।  আজকের পৃথিবীতে সমকামীতার ব্যাপারটা আর লুকোচুরির পর্যায়ে নেই।  Gay Pride Day এখন আর শুধু সমকামীদের অধিকার আর গৌরব বহন করে না অনেকের জন্যই এটার অর্থ আরও  ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে।  এটাকে সামগ্রিক মানবাধিকারের একটা অংশ হিসেবেও দেখা হয়।   কিন্তু এই লেখাটা সেরকম কোন নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়এই পোষ্ট টা লিখছি দুটা কারণে।  প্রথমত, আমি এ পর্য্যন্ত কোন লেখা পড়িনি যেখানে কোন গে বা লেসবিয়ান কে  খুব কাছ থেকে দেখার (আমি ভালো পরিচয় ইত্যাদি বুঝাচ্ছি না) অভিজ্ঞতা আছে, আর দ্বিতীয়ত আমার কিছু পরিচিতদের মতে কোন মেয়ে ব্লগার সাধারণত এই ধরনের আলোচনায় অংশ নেয় না।   

আমার খুব কাছের একজন সমকামী।  বাংলাদেশে বড় হওয়ার কারণেই হোক বা যে কারণেই হোক আমার নিজেরো খুব ভালো মতোই homophobia  ছিলো - এটাকে অস্বাভাবিক এবং অন্যায় ভাবতাম।   আমি আসলে এখন নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করিযখন প্রথম জানতে পারি যে আমার খুব প্রিয় একটা মানুষ সমকামীআমি বাধ্য হই নিজের ভেতরের ছোট থেকে মেনে নেওয়া মূল্যবোধগুলোর মুখোমুখি হতে।  এটা যদি দূরের কেউ হতো তাহলে আমিও হয়তো ব্যাপারটা   আরো বহুদিন ওরকম ভাবেই দেখতাম।  কিন্তু তখন সব social norm  বা  taboo  র  চাইতে বড় ছিলো তাকে  এবং   জিনিষটাকে বোঝার চেষ্টা করা।  সমকামীদের সারাজীবনই সমাজের সাথে যুদ্ধ করে যেতে হয় কিন্তু তাদের প্রথম  বড় যুদ্ধ নিজেদের সাথে।  নিজের কাছে স্বীকার  করে নেয়া যে সে অন্যদের মতো স্বাভাবিকনা, সে এমন একটা কিছু যেটাকে  ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়,    তার এমন একটা বিশেষত্বআছে যে কথা জানতে পারলে তার সব প্রিয় মানুষগুলো তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে - এটা কি পরিমাণ অসহণীয় কষ্টের হতে পারে তা হয়তো আমরা যারা কখনো এরকম সব হারাবার ভয় এর মুখোমুখি হই নি তারা ঠিক বুঝতে পারবো না।    

তারপর এদেশে (আমেরিকায়) আসার পর আমার বেশ বড়ো একটা গে লেসবিয়ান  কমিউনিটির সাথে পরিচয় হয় এবং আমি আরো কি কি আবিষ্কার করি জানেন?        সাধারণত সমকামীদের  নিয়ে যে প্রচলিত ধারনাগুলো আছে - যে সমকামী ছেলেরা একটু মেয়েলী’  হবে, হাত পা বেশী বেশী নাড়িয়ে কথা বলবে, অথবা heterosexual ছেলেদের তুলনায় বেশি ফ্যাশন সচেতন হবে, লেসবিয়ান মেয়েরা একটু পুরূষালীহবে -  এমন কোন কথাই নেই।  এরাওরকম হয় আবার হয় ও না।  মানে আমি বলতে চাচ্ছি যে আমার চেনা অন্তত ৮০ শতাংশ ওরকম না- হতে পারে এটা হয়তো একটা খন্ড চিত্র মাত্র  কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা  তাই।        

তার চেয়েও বড়ো কথা যেহেতু এরা নিজেরা  mainstream এর  বাইরের মানুষ তাই   এদের অন্যান্য প্রান্তিক মানুষগুলোর প্রতি একটা সহজাত সহানুভূতি থাকে।  আমার চেনা সমকামীদের একটা বড়ো অংশ প্যালেষ্টাইন ইস্যু মেয়েদের  বিরুদ্ধে ভায়োলেন্স, নারীবাদ, পরিবেশ দূষণ, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ, মানবাধিকার রক্ষা এবং আরও    বিভিন্ন ধরনের সামাজিক/ রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আন্দোলনে জড়িত।   শুধু জড়িত বললে আসলে কম বলা হবে এদের অনেকের জন্য নিজের নিজের বিশ্বাসের বাস্তবায়নের চেষ্টাটাই জীবন।   আমার চেনা একটা  সাদা  আমেরিকান ইহূদী লেসবিয়ান কি করে জানেন প্যালেষ্টাইনে গিয়ে  যখন ইজ্রায়েলিরা বিভিন্ন প্যালেষ্টানিয়ান বসতি  উচ্ছেদ করার জন্য ট্যাঙ্ক নিয়ে আসে, মেয়েটা সেই ট্যাঙ্কের সামনে গিয়ে দাঁঁড়িয়ে থাকেযেতে হলে ওকে পিষে এগোতে হবে।   যেহেতু সে আমেরিকান নাগরিক তাই সত্যি সত্যি তাকে পিষে ফেলে না, খালি ইজরায়েলি  জেলে নিয়ে দিনের পর দিন ফেলে রাখে।  মেয়েটাকে আমেরিকায় ফের পাঠানো হয়, মেয়েটা আবার যায় 

সমকামীতা সম্পর্কে আমি খুব বেশী কিছু হয়তো জানি না , কিছু সমকামী সম্পর্কে কিছু জানি - সেটাই লিখলাম।  ওদের অনেকের কাছে আমার একটা ব্যক্তিগত ঋণ আছে -  দৃষ্টিটাকে নিজের বাইরে প্রসারিত করার শিক্ষা আমি প্রথম ওদের কাছেই পাই

 

বিঃদ্রঃ  সমকামীতা নিয়ে অভিজি রায়ের গবেষণা ভিত্তিক লেখাটি আমার অতি প্রিয় লেখাগুলোর অন্যতম।  আমার লেখাটি যেমন ব্যক্তিগত আবেগ থেকে লেখা, ওটি তেমনি বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে বিস্লেষণ করে দেখানো -  সমকামী কি বিষমকামী  আমরা সবাই একই  স্পেকট্রামের মধ্যেই  একটু এখানে আর  একটু ওখানে  অবস্থান করি। 


স্নিগ্ধা আলী, আমেরিকার কর্ণেল ইউনিভার্সিটিতে সমাজবিজ্ঞানে পিএইচডি করছেন। সমাজ, মানবাধিকার, নারীবাদ প্রভৃতি বিষয়ে লেখালিখি করেন।