বিজ্ঞানের অংগনে যখন ধর্মের প্রবেশ
দুটোর যৌক্তিক পার্থক্য কি এতো সহজ? 

রির্চাড ডকিন্স
অনুবাদ
ক: তানবীরা তালুকদার

পুর্ববর্তী পর্বের পর ... 

বিজ্ঞানের অংগনে ধর্ম

আমরা নৈতিকতার মূল্য নিয়ে আলোচনা করতে করতে মূল বিষয় থেকে দূরে সরে এসেছি। এখন আমি আমার মূল আলোচনা বিবর্তনবাদে ফিরে যাবো দেখব পোপ আমাদের প্রত্যাশানুযায়ী বিজ্ঞান-মনস্কতার ঝান্ডা উর্ধ্বে তুলে ধরতে পেরেছেন কিনা Pontifical Academy of Sciences কে তার বিবর্তনবাদের উপর দেয়া বানীটি শুরুই হয়েছে নেতিবাচকভাবে দুমুখো ভাবধারার কথা দিয়ে যার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে দ্বিতীয় জন পলের আগের উক্তির সাথে মিল রাখা। আরো সন্দেহজনক হলো  বারোতম পিয়াসের একটি উক্তির অন্তর্ভুক্তি -যিনি অন্যান্যদের তুলনায় বিবর্তনবাদের প্রতি খুবই বিরূপ। এখন পোপ এলেন আরো কঠিন কাজ করতে, বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমানের সাথে ঐশী প্রত্যাদেশের মিলন ঘটাতে। 

 

ধর্মগ্রন্থে বলা হয়, মানুষের সৃষ্টি হয়েছিল সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে এবং তার অবয়ব থেকে ... যদি মানুষ পুর্ববর্তী কোন জীবন থেকে তৈরী হয়ে থাকে তাহলে তার ঐশ্বরিক আত্মা সাথে সাথে সৃষ্টিকর্তা তৈরী করে দেন...... তারফলে তারা মনে করে জীবন্ত প্রানীর সব শক্তির আবির্ভাব হয় আত্মা থেকে, আর বিবর্তনবাদ শেখাচ্ছে পুরো উল্টোটা - আত্মা ছাড়াই কিভাবে প্রাণের বিকাশ আর বিবর্তন হতে পারে - নাকি নিছক দৃষ্টি আকর্ষন করার মত ব্যাপার কেবল এটা, মানুষের সৃষ্টির সাথে সম্পূর্ন  সামঞ্জস্যহীন ...... এ দ্বিমুখী দন্দ্বে আমরা মানুষেরা নিজেরা অস্তিত্বের প্রশ্নে মনস্তাত্বিক একটা  বিভ্রমের মধ্যে পড়ে যাই, যেটাকে অস্ত্বিত্বের বিষয়ে একটা বিরাট ফাকও বলা যেতে পারে।

এ ব্যাপারে পোপকে একটা বাহবা দিতে হয় যে তিনি তখন অনুধাবন করেছেন যে সম্পূর্ন দুই মেরুতে অবস্থিত দুটো বিপরীতধর্মী ব্যাপারকে তিনি জোর করে এক করতে চাইছেন - "যাহোক এ ধরনের অস্ত্বিত্বর বিষয়ে অবস্থান না গ্রহন করাটাই কি বাস্তবে পদার্থ এবং রসায়নের জগতে বিবর্তন এর উপর গবেষনার মূল ধারা নয়?'

 

ভয়ের কিছু নেই।  অস্পষ্টতা আর নানাপদের আগডুম বাগডুম  মুক্তির উপায় বালে দিচ্ছে:

 

'জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যে পদ্ধতি বহু বার ব্যবহার করা হয়েছে তার দ্বারা দুটো ভিন্নধর্মী মতামতকে এক করা সম্ভব হয়, যাদের এক হওয়াকে আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব বলে মনে হয়। বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষন বর্ননা এবং পরিমাপের মাধ্যমে জীবনের বিভিন্ন দিক স্পষ্ট করে ব্যাখা করে এবং সময়ের সাথে সাথে আরো নির্ভুল ভাবে একে জীবনের সাথে যুক্ত করে। আধ্যাত্মিক  সাধনার বিশেষ মূহুর্তকে এভাবে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করা যায় না, তথাপি এটা একটা গবেষনামূলক স্তরের আবিস্কার -যা মানব জীবনের সাথে সম্পর্কিত অনেক নিদির্ষ্ট মূল্যবান জিনিসের প্রতি ইঙ্গিত করে।'

 

সোজা ভাষায় বলতে গেলে, বিবর্তনবাদের নিদির্ষ্ট একটা লক্ষ্যে পৌছার একটা সময় এলো যখন সৃষ্টিকর্তা মানুষের আত্মাকে পূর্ববর্তী প্রানীর বংশের মধ্যে অন্তর্গত এবং সঞ্চারিত করলেন। (কখন? দশ লক্ষ বছর আগে? বিশ লক্ষ বছর আগে? Homo erectus আর জ্ঞান সম্পন্ন Homo sapiens মানুষের মধ্য? নাকি  Homo sapiens মানুষ আর H. sapiens sapiens - মানুষের মধ্যে?) হঠা  করে আত্মা সঞ্চারনের অবশ্যই দরকার আছে, নইলে তো মানবজাতির জন্য অতি প্রয়োজনীয় ধর্মের ভিত্তিই ধ্বসে পড়ে। তুমি আহারের জন্য প্রানী হত্যা করতে পারো, কিন্তু ভ্রুন হত্যা কিংবা দুরারোগ্য ব্যাধীতে আক্রান্ত মানুষের যন্ত্রনাহীন মৃত্যু তাদের দৃষ্টিতে অযৌক্তিক জীব হত্যা, কারন -এক্ষেত্রে মহামূল্যবান 'মানব জীবনের' প্রশ্ন জড়িত

 

ক্যাথলিজমের জাল কেবল নৈতিক বিবেচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ  ভাবলে ভুল হবে।  ক্যাথলিক ধর্মানুসারীরা বিশ্বাস করে আধুনিক সভ্য Homo sapiens মানুষের সাথে অন্য সমস্ত 'ইতর প্রানী জগতের' একটি বিরাট বিভেদ আছে। আর বিজ্ঞানের চোখে এই বিভেদ একেবারেই ভ্রান্তবলা নিষ্প্রয়োজন, আজকের যুগে আকস্মিক ভাবে কোন ধরনের অমর আত্মার মাধ্যমে প্রানের বিকাশের কথা বিবর্তনবাদের কাছে বৈজ্ঞানিক ভাবে অগ্রহনযোগ্য।

 

আরো সাধারনভাবে বলতে গেলে, এটা বলা খুবই অযৌক্তিক, যেমন গুল্ডস এবং অন্যান্যরা বলে থাকেন, যে 'ধর্ম নিজেই বিজ্ঞানের অংগন থেকে দূরে অবস্থান করে, এবং শুধু নৈতিকতা আর মূল্যবোধের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে।' ঈশ্বার নামকএকটি অলৌকিক সত্ত্বা দ্বারা সৃষ্ট এবং তার দ্বারা বিরাজিত মহাবিশ্ব, প্রকৃতগতভাবে এবং গুনগতভাবে ঈশ্বরবিহীন মহাবিশ্ব থেকে আলাদা হওয়ারই কথা। আর সেই বিভেদটিই হলো অপরিহরনীয় বৈজ্ঞানিক পার্থক্য। ধার্মিকেরা যে সত্ত্বার অস্তিত্বের দাবী করে, তা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাদের বৈজ্ঞানিক দাবীকেই উপস্থাপন করতে চায়

 

প্রধান প্রধান রোমান ক্যাথলিক চার্চগুলোর বেশীর ভাগই এই ধরনের দাবীর প্রতি আস্থাশীলবিনা ঔরসে কুমারীর মাতার সন্তান প্রসব, কুমারী মেরীর সশরীরে স্বর্গপ্রবেশ, সমাধি থেকে যীশূর পুনরুত্থান, মৃত্যুর পরে আমাদের আত্মার জবাবদিহিতা, -এগুলো  ভুল হোক, ঠিক হোক - যথার্থ বৈজ্ঞানিক দাবী। হয় যীশূর একজন সত্য সত্যই বাবা ছিলেন নতুবা নয়। যথার্থ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিসার মাধ্যমেই এর জবাব মিলতে পারে। এটা কোন নৈতিকতা কিংবা মূল্যবোধের প্রশ্ন নয়, এটা হলো বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা  তথা সত্যান্বেষী মননের প্রশ্ন। আমাদের কাছে এটার জবাব দেয়ার মতো সাক্ষ্যপ্রমান হয়তো নেই কিন্তু এটি  যে একটি বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন -এতে তো কোন সন্দেহ নেইতবে বিজ্ঞান যদি অদূর ভবিষ্যতে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো কোন প্রমান খুঁজে পায়,  আপনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন, ভ্যাটিকান সেটিকে উচ্চারনও করতে দেবে না।

 

যখন মাতা মেরী মারা যান, হয় তখন তার দেহ বিনষ্ট হয়ে গেছে, নতুবা তার দেহ এই পৃথিবী থেকে স্বসরীরে স্বর্গে তুলে নেয়া হয়েছে। আনুষ্ঠানিক দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত রোমান ক্যাথলিক চার্চ এর অনুমান, সম্প্রতি ১৯৫০ সালে তারা অধ্যাদেশ জারি করেছেন, যেখানে তারা বলেছেন স্বর্গ জিনিসটার সত্যিকারের 'ভৌগলিক অস্তিত্ব' বাস্তবিকই আছে, নইলে একজন রমনীর শরীর কিভাবে সেখানে গেলো?  আমি একথা এখানে বলছি না যে, কুমারী মাতাকে নিয়ে অনুমিত এই মতবাদ আসলেই মিথ্যা, (যদিও আমি বিশ্বাস করি এটি অবশ্যই মিথ্যাই হতে হবে)। আমি শুধু এই যুক্তিই খন্ডন করতে চাচ্ছি যে, যারা বলেন এ ধরণের দাবী বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের বাইরে রাখতে হবে।  বরং, এই কুমারীর এই গল্পটি সত্য কিনা তা বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে নির্ণয় করা যেতে পারে - এটি তাই পরীক্ষণযোগ্য একটি বৈজ্ঞানিক তত্ব। আমাদের শারীরিক ভাবে মৃত্যু হলে আমাদের আত্মার জবাবদিহি করতে হবে কিনা কিংবা সেই সাথে ফেরেশতাদের দ্বারা বিচারপর্বের গল্প, স্পষ্টতই মাদার মেরীর সাথে যুক্ত হওয়ার অলৌকিক গল্পসমূহ, এবং এধরনের অন্যান্য সব গল্পসমূহ-এর ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে

 

প্রায়শই খুব অস মতবাদ অবলম্বন করে বলা হয় যে কোন ধর্মীয় দাবীই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের বাইরে। অন্যদিকে এরাই আবার অতি প্রাকৃতিক রং-বেরং-এর গল্প সমূহ, এবং মৃত্যুর পরের জীবনের কথা বলে সাধারন মানুষদেরকে অভিভূত করার চেষ্টা থাকে, নিজের দল ভারী করে গোপন উপায়ে জেতার চেষ্টা, কিংবা উপসনালয় বৃদ্ধির চেষ্টা থাকে। এটাই তাদের বৈজ্ঞানিক শক্তি যা তাদেরকে এ সমস্ত গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে উপস্থাপন করার সার্মথ্য দেয়। এবং একই সময়ে সে সব বিষয়ের যৌক্তিক ব্যাখ্যা, বৈজ্ঞানিক গবেষনা  কিংবা নুন্যতম সমালোচনাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়  - 'এগুলো ধর্মের বিষয়, বিজ্ঞানের এখান থেকে দূরে থাকা উচি'  কিন্তু তুমি গাছেরটাও খাবে - তলারটাও কুড়োবে - এ তো হতে পারে না। অন্তত ধর্মের তাত্বিক আর আত্মপক্ষ সর্মথনকারী্দের এই দুমুখো নীতিকে আমাদের কখনোই প্রশ্রয় দেওয়া উচি না। দূভার্গ্যবশতঃ তারপরো, আমাদের মধ্যে অনেকেই, এমনকি যারা ধর্মে বিশ্বাস রাখেন না তারাও অম্লান বদনে তাদেরকে একাজ গুলো অহরহই করতে দেই।

 

আমার মতে, সনাতন কট্টর মৌলবাদীদের বিপক্ষে পোপকে দলে টেনে আত্মপ্রসাদ লাভের একটা প্রচেষ্টাএতে অবশ্য খুশী হবার মত কারণ আছে - যারা ক্যাথলিক ধর্মের প্রবক্তা যেমন মাইকেল বিহেদের পায়ের তলা থেকে আস্তে আস্তে মাটি সরে যাচ্ছে। তারপরেও যদি আমাকে বলা হয় সত্যিকারের সনাতন ঈশ্বর-বিশ্বাসী, ধর্মগ্রন্থ   মেনে চলা ধার্মিক আর অন্যদিকে  কপট, দুমুখোস্বভাবের,  গোঁজামিল দেওয়া বক-ধার্মিকদের মাঝ থেকে াউকে গ্রহণ করতে, আমি জানি আমাকে কোনটা গ্রহন করতে হবে।

 

তানবীরা তালুকদার

০৫.০৫.২০০৮

=========

লেখাটি আমাদের মুক্তমনার পরবর্তী বই -‘বিজ্ঞান ও ধর্ম – সংঘাত নাকি সমন্বয়?’– প্রকাশিতব্য সংকলন-গ্রন্থের জন্য নির্বাচিত হল - মুক্তমনা সম্পাদক।