বাংলা ব্লগ

বিবর্তনের আর্কাইভ

বিবর্তন ব্লগ

মুক্তমনা কি?

প্রজেক্ট

ইবই

সাহায্য


  ভ্রান্ত ধারণা

 

প্রথম কোষ দৈব প্রক্রিয়ায় তৈরি হতে পারে না।

 

১) প্রথম জৈবকোষ স্রেফ দৈব প্রক্রিয়ায় বা চান্সের মাধ্যমে তৈরি হয়নি। জৈব রসায়ন কোন চান্সের খেলা নয়।  কাজেই স্রেফ সম্ভাবনার নিরিখে জৈব রসায়নের প্রক্রিয়া পরিমাপ করা অর্থহীন।  এপ্রসঙ্গে পড়ুন সম্ভাবনার নিরিখে প্রাণের উদ্ভব খুব বিরল ঘটনা  -এই দাবীর উত্তর

 

২)  প্রথম জৈবকোষ তৈরি হয়েছে ধাপে ধাপে। বিজ্ঞানীরা আদি জীবকোষ তৈরির পেছনে যে ধাপগুলোকে ইতোমধ্যেই সনাক্ত করেছেন সেগুলো হল[1] -

 

ধাপ-১: জৈব যৌগের উপত্তি :

  • হাইড্রোকার্বন উপাদন (মুক্ত পরমাণুগুচ্ছ  CH এবং CH2 এর বিক্রিয়া, বাষ্পের সাথে মেটালিক কার্বাইডের বিক্রিয়া)

  • হাইড্রোকার্বনের অক্সি ও হাইড্রক্সি-উপজাতের উপাদন (বাষ্প ও হাইড্রোকার্বনের বিক্রিয়ায় এলডিহাইড, কিটোন উপাদন) 

  •  কার্বোহাইড্রেট উপাদন (গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ আর ঘনীভবনের ফলে চিনি, স্টার্চ, গ্লাইকোজেন) ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারলের উপত্তি (ফ্যাট বা চর্বির ঘনীভবন) 

  • অ্যামাইনো এসিড গঠন (হাইড্রোকার্বন,  অ্যামোনিয়া আর পানির বিক্রিয়া)

 

ধাপ-২: জটিল জৈব অণুর উপত্তি (পলিমার গঠন)

  • প্রোটিনয়েড মাইক্রোস্ফিয়ার

  • কো-এসারভেট

 

ধাপ-৩: পলিনিউক্লিয়োটাইড বা নিউক্লিক এসিড গঠন

 

ধাপ-৪: নিউক্লিয়োপ্রোটিন গঠন

 

ধাপ-৫: আদি কোষ বা ইউবায়োন্ট গঠন (কো-এসারভেটের ভিতরে নিউক্লিয়োপ্রোটিন আর অন্যান্য অণু একত্রিত হয়ে লিপোপ্রোটিন ঝিল্লি দিয়ে আবদ্ধ প্রথম কোষ; প্রথম জীবন)

 

ধাপ-৬: শক্তির উস ও সরবরাহ (শক্তির সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেওয়ায়, প্রকৃতিতে টিকে রইল তারাই যারা প্রোটিনকে এনজাইমে রূপান্তরিত করে সরল উপাদান থেকে জটিল বস্তু তৈরী করতে পারত, আর সেসব দ্রব্য থেকে শক্তি নির্গত করতে পারত)

 

ধাপ-৭: অক্সিজেন বিপ্লব (অক্সিজেনহীন বিজারকীয় আবহাওয়া অক্সিজেনময় জারকীয় আবহাওয়ায় রূপান্তরিত হল - আজ থেকে দু’শ কোটি বছর আগে)

 

ধাপ-৮: প্রকৃত কোষী জীবের উপত্তি (প্রোক্যারিওট থেকে ইউক্যারিওট)

 

ধাপ-৯: জৈব-বিবর্তন বা  বায়োজেনেসিস (জীব থেকে জীবে বিবর্তন)

 

ধাপগুলোকে প্রবহচিত্রের সাহায্যে সাজালে দেখাবে অনেকটা এরকম[2] -

 

 

চিত্রঃ আদিম পরিবেশ থেকে জৈববস্তুর উপত্তি ও তাদের আন্তঃসম্পর্ক ও বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জীবনের উপত্তির রূপরেখা (আখতারুজ্জামান, ২০০৪)

 

তাছাড়া, প্রাণের উপত্তির ধাপ সম্বন্ধে বিস্তৃতভাবে জানার জন্য 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' (অবসর, ২০০৮) বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়টি (প্রাণের উপত্তির ধাপগুলো) পড়া যেতে পারে। অধ্যায়টি মুক্তমনায় রাখা আছে এখানে

 

৩) প্রাণের রাসায়নিক উপত্তি তত্ত্বের (ওপারিন এবং হালডেন তত্ত্ব) মাধ্যমে সরল প্রাণের উদ্ভব এবং পরবর্তীতে প্রটোসেলের উদ্ভব, কিংবা ইউক্যারিওট বা প্রকৃতকোষী জীবের উদ্ভবসহ বহু স্তরই পরবর্তী গবেষকদের পরীক্ষালব্ধ গবেষণায় (Urey–Miller, 1953[3], 1959[4] Fox 1960[5]; Fox and Dose 1977[6], Cairn-Smith 1985[7], de Duve 1995[8], Russell and Hall 1997[9]; Wächtershäuser 2000[10], Smith et al. 1999[11], Huber et al. 2003[12]) সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এপ্রসঙ্গে দেখুন - বিবর্তন প্রাণের উপত্তি ব্যাখ্যা করতে পারে না -এই দাবীর উত্তর

 

৪) এ ছাড়া সম্প্রতি ক্রেগ ভেন্টর  তার সিন্থেটিক লাইফের গবেষণা থেকে প্রথম কৃত্রিম জীবকোষ তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন[13]

 

কাজেই জৈব কোষের উপত্তির পেছনে কোন অলৌকিক ক্রিয়া কলাপ নেই। বরং প্রাথমিক জৈবকোষের উপত্তি হয়েছে প্রাকৃতিকভাবেই রাসায়নিক বিবর্তনের পরিক্রমায়। বলা বাহুল্য, রাসায়নিক পরিবর্তনের এই ধাপগুলো কিন্তু একদিনে সম্পন্ন হয়নি।  প্রোটিন এবং নিউক্লিক এসিড স্বতঃস্ফুর্তভাবে  নানা ধরনের ভিন্ন ভিন্ন সমাবেশে সংগবদ্ধ হয়েছে লক্ষ কোটি বছর ধরে। প্রকৃতি নিজেই নিজের উপর আকস্মিকতার পরীক্ষা -নিরীক্ষা করেছে বিস্তর।  ফলে অজৈব পদার্থ থেকে একসময় উদ্ভুত আদি কোষগুলো  নিউক্লিয়িক এসিডের সমন্নয়ে অনুলিপির ক্ষমতা অর্জন করেছে, আর সময়ের সাথে সাথে বিবর্ধিত করেছে।  আসলে সহজ কথায় সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে জটিলতা। এই জটিলতা বৃদ্ধিই জীবন বিকাশের এক অত্যাবশ্যকীয় শর্ত।  জটিলতার অর্থ সংবাদ বা তথ্যের বৃদ্ধি। যে অণু যত সরল ও ছোট, তার ভিতরকার সংবাদ ও তথ্য তত কম। অণু যত দিনে দিনে বৃহ আকার অর্জন করেছে, এক থেকে বহুত্ব অর্জন করেছে, ছোট কণা থেকে বড় কণায় রূপান্তরিত হয়েছে- বৃদ্ধি করেছে জটিলতার। তাই সংক্ষেপে বলা যায়, জীবন বিকাশের আগে দরকার ছিল জটিলতা বৃদ্ধির। জটিলতা বাড়তে বাড়তে যখন জীবনোপযোগী পরিবেশ তৈরী হল, অর্থা তথ্যের পাহাড় জমল, তখনই শুরু হল প্রকৃত জীবন[14]

 

প্রাসঙ্গিক আলোচনা :

সম্ভাবনার নিরিখে প্রাণের উদ্ভব খুব বিরল ঘটনা -এই দাবীর উত্তর


 

[1] অভিজি রায় এবং ফরিদ আহমদে,মহাবিশ্বের প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, অবসর, ২০০৭ (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত ২০০৮)

[2] ড. ম. আখতারুজ্জামান, বিবর্তনবিদ্যা, বাংলা একাডেমী (১৯৯৮);  ২য় সংস্করণ, হাসান বুক হাউস (২০০৪)

[3] Miller, Stanley L., "Production of Amino Acids Under Possible Primitive Earth Conditions" Science 117 (3046): 528, 1953

[4] Miller, Stanley L.; Harold C. Urey, "Organic Compound Synthesis on the Primitive Earth". Science 130 (3370): 245, 1959

[5] Fox, S. W. How did life begin? Science 132: 200-208, 1960.

[6] Fox, S. W. and K. Dose. Molecular Evolution and the Origin of Life, Revised ed. New York: Marcel Dekker, 1977.

[7] Cairn-Smith, A. G. Seven Clues to the Origin of Life, Cambridge University Press, 1985.

[8] de Duve, Christian, The beginnings of life on earth. American Scientist 83: 428-437, 1995

[9] Russell, M. J. and A. J. Hall, The emergence of life from iron monosulphide bubbles at a submarine hydrothermal redox and pH front. Journal of the Geological Society of London 154: 377-402,  1997.

[10] Wächtershäuser, Günter, Life as we don't know it. Science 289: 1307-1308, . 2000.

[11] Smith, J. V., F. P. Arnold Jr., I. Parsons, and M. R. Lee. 1999. Biochemical evolution III: Polymerization on organophilic silica-rich surfaces, crystal-chemical modeling, formation of first cells, and geological clues. Proceedings of the National Academy of Science USA 96(7): 3479-3485.

[12] Huber, Claudia, Wolfgang Eisenreich, Stefan Hecht and Günter Wächtershäuser. 2003. A possible primordial peptide cycle. Science 301: 938-940.

[13] J. Craig Venter, Creation of a Bacterial Cell Controlled by a Chemically Synthesized Genome, Science DOI: 10.1126/science.1190719

[14] অপরাজিত বসু, প্রাণের রহস্য সন্ধানে বিজ্ঞান, শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানী, জানুয়ারি ১৯৯৯ (পুনর্মূদ্রণ ২০০২)

প্রশ্নোত্তরে বিবর্তন