শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ ও মুক্তমনার নিবেদন মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা)

বাঙালীর জাতীয় মুক্তির প্রধান অন্তরায়

বেলাল বেগ

 

মানবজীবনে রাষ্ট্রের ভূমিকা বিবেচনায় এনে ‘ফান্ড ফর পিস’ নামীয় একটি মার্কিন গবেষণা সংস্থা বিশ্বের ২৮টি রাষ্ট্রকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসাবে অভিহিত করেছে মাত্র কয়েক মাস আগে ২০০৬ সালে। একশ নম্বরে ৯৬.৩ পেয়ে বাংলাদেশ তাতে ১৯তম স্থান দখল করেছে। এর আগে পরপর বহু বছর দুর্নীতিতে বাংলাদেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ছিল। এসব কথা মনে এলে আশরাফুলের ব্যাট কি ঝলসে উঠতে পারে? মাশরাফি কি ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে বাঘের মত? বুক টান করে দাঁড়াতে পারবেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিশ্বদূত? কিন্তু তারপরেও ক্রিকেটে আমরা একদিন ওয়ার্ল্ডকাপ জিতবই, তারপরেও বাংলাদেশের প্রতিনিধি বিশ্বসভায় দাঁড়ালে করতালিতে মুখর হয় জেনারেল এসে¤¦লীর বিশাল হলঘর কারণ বিশ্বশান্তি রক্ষায় বাঙালী সৈন্যরা সকলের সেরা। একজন বাঙালী ডঃ ইউনূসের সম্মানে দাঁড়িয়ে যান পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রপ্রধান। এরপরেও বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলা হলে আমাদের বুঝতে বাকি থাকেনা যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিভাবান বাঙালী জাতির আপামর মানুষের প্রতিভা বিকাশের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে না।


বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র এ বাক্যটি ইতিহাস জানা একজন বাঙালীর সর্বাঙ্গে ক্ষোভ-দুঃখ ও ক্রোধের আগুন ধরিয়ে দেবে। অতীতে এই বাঙালীরা পৃথিবীর কোথায় কোথায় উপনিবেশ গড়েছিল, কোন কোন দেশ জয় করেছিল, সারা দুনিয়া থেকে কেন ছাত্রশিক্ষক ও বণিকরা বঙ্গদেশে আসত ইত্যকার বাঙালী প্রতিভার অতীতচর্চা নাইবা করলাম; বৃটিশ-পলায়ন পরবর্তী কথাই ধরা যাক না কেন। এই বাঙালীই ত জীবন বিসর্জন দিয়ে মাতৃভাষা রক্ষা করেছে, এই বাঙালীই ত যুদ্ধ করে স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপন করেছে। যুদ্ধজয় করা একটা বীরের জাতির রাষ্ট্র ব্যর্থ হয় কি করে? কেন এই ক্ষমাহীন ব্যর্থতা? এই ব্যর্থতার কোন সে একটি কারণ?


দেশের যে কেউ বলবে আমাদের সকল ব্যর্থতার একটিই কারণ- আমাদের রাজনীতি ঠিক নেই। বাঙালীর অহংকার নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূসও ঐ কথা বললেন। শুধু তাই নয়, তার বিহিত করতে তিনি নিজেই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে চাইলেন। জীবনে প্রথমবারের মত পরাজয় বরণ করে তিনিও পিছু হঠে গেলেন। যে ভয়ানক কারণে বিশ্বজয়ী সাংগঠনিক প্রতিভা ইউনূস এ জাতির উদ্ধারে এগিয়ে এলেন না, তার নাম রাজনৈতিক সংঘাত। এ রোগ সহজে সারেনা। আসলে রোগের ঔষধটি ড. ইউনূসের জানা নেই।


বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ব্যর্থতার জন্য যে রোগটি মূলতঃ দায়ী তা নিয়ে মাথায় মৃত্যুপরোয়ানা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও কানাডায় বসে তিনযুগ ধরে নীরবে নিভৃতে গবেষণা করেছেন একজন বায়ো-কেমিস্ট। সম্প্রতি তিনি তাঁর গবেষণার ফল প্রকাশ করেছেন। তিনি যে অভ্রান্ত তার প্রথম প্রমাণ ১৯৫২ সনে নির্মিত হবার পর রাতের আঁধারে প্রথম শহীদমিনারটির ভাঙ্গা। সেই থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত জামাতে ইসলামী আমাদের শহীদ মিনারে যায়নি। ১৯৭১ সনে ২৫ মার্চ ভয়ঙ্কর যে রাতে ঢাকা শহরের ঘুমন্ত বাঙালীদের হত্যা করে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, সে রাতে শহীদমিনারও বোমা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। বাঙালীর ঐ দুষমনদের সংগে যোগ দিয়েছিল জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম অর্থা
ইসলাম ধর্মকে যারা রাজনীতি হিসাবে মানে, তারা। ১৯৭৫ সনে বাঙালী জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যাপূর্বক ঐ জামাতকেই আবার পুনর্বাসিত করে দেয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একাংশ। মূলতঃ জামাত-অনুসৃত রাজনীতির পাহারার উদ্দেশ্যেই পরবর্তীকালে গড়ে উঠে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। সাম্প্রতিককালের চারদলীয় জোট রাজনৈতিক ইসলাম প্রতিষ্ঠার দুর্গ হিসাবে গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে দখল করার জন্য একদিকে যেমন তারা সেনাবাহিনীসহ সকল সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, পার্লামেন্ট, ব্যবসায়-বাণিজ্য ইত্যাদি রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক আধিপত্য বিস্তার করে নেয়, অন্যদিকে সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য নানা নামে অসংখ্য ইসলামী জঙ্গিবাহিনী গড়ে তোলে। জামাতের গড়ে তোলা ইসলামী বাহিনীগুলি ও আমরা হব তালিবান, বাংলা হবে আফগান বলে স্লোগান দিয়ে চুপ করে থাকেনি। গত শতাব্দীর শেষবছর থেকে এ পর্যন্ত অনবরত বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে এদের হাতে দেশের বহু কৃতী সন্তানসহ বহু মানুষ নিহত হয়েছে।


রাজনৈতিক ইসলামের লক্ষ্য বিশ্বাধিপত্য। তাই যেখানেই এর প্রকোপ দেখা যায়, সেখানেই মানবাধিকার লংঘিত হয় ও সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলি সেখানেই যুদ্ধ ও ধ্বংসের তা-ব নিয়ে উপস্থিত হয়। বস্তুতঃ পশ্চিমা শক্তির ভয় না থাকলে চারদলীয় জোট আমলে বাংলাভাইদের যে উত্থান হয়েছিল, নির্বাচন হউক বা না হউক, এতদিনে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল মানুষগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত (যেমন, অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই আওয়ামী লীগকে ফতোয়াবাজদের সংগে আঁতাত করতে হয়েছিল)। রাজনৈতিক ইসলামের অভ্যুত্থান থেকে আমরা যে এখন নিরাপদ নই, তারই প্রমাণ, ৬জন ইসলামী জঙ্গী নেতাকে ফাঁসি দেবার পরেও, দেশে সামরিক নিরাপত্তা থাকার পরেও, ৫০০-বোমার সমন্বিত বিস্ফোরণের মত সমন্বিত বিস্ফোরণ ঘটেছে গত ১লা মে। আরো বড় ঘটনাও যে ঘটবেনা তা নিশ্চয় করে বলা যায় না। বলা বাহুল্য, রাজনৈতিক ইসলামকে সমূলে উৎপাটন করা না গেলে, ইরাক ও আফগানিস্থানে অবস্থানরত আমেরিকান ও বৃটিশ সৈন্য যে কোন মুহূর্তে বাংলাদেশেও ঢুকে যেতে পারে। বাংলা আফগান হয়ে যাবে আমার আপনার লাশের বিনিময়ে।


রাজনৈতিক ইসলামের এত শক্তি কেন? কোরান-হাদীস নিয়ে সুদীর্ঘ তিনযুগ গবেষণায় হাসান মাহমুদ অজস্র দলিল ও বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ থেকে দেখিয়েছেন যে এর কারণ, একদল সুবিধাভোগী মুসলমান নিজেদের ভোগদখলের স্বার্থে ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণী সাধারণ মুসলমানদের কাছ থেকে আড়াল করে তার একটা মনগড়া রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের হাত করে ফেলেছে। কোরান-হাদীস স¤¦ন্ধে সাধারণ মানুষ বেশি জানে না কিন্ত তারা যেহেতু আল্লাহ্ এবং রাসুলকে মানে, আল্লার রাজত্ব ও রাসুলের আদর্শ বললে তারা সহজে অভিভূত হয়। আল্লার রাজত্ব কায়েম হোক, তা তারা অবশ্যই চাইবে। কিন্তু জামাতে ইসলামী প্রচারিত মওদুদীর পথ যে আল্লাহ্ এবং রাসুলের উল্টোপথ, তা সাধারণ মুসলমান জানে না। হাসান মাহমুদ কোরানের কোন নতুন ব্যাখ্যা দেননি। তিনি কেবল বহু ইসলামী দার্শনিক-বিশেষজ্ঞের ব্যাপক উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেছেন কোরান কোন আইনের বই নয়, এটি কেবল জীবনে সহজ পথে (সেরাতুল মুস্তকিম) চলার উপদেশ মাত্র। তিনি প্রমাণ করেছেন মানবাধিকার রক্ষাই কোরানের লক্ষ্য। মাহমুদ দেখিয়েছেন, প্রকৃত ইসলামে শারিয়া, রাষ্ট্র, ফতোয়া, এ-সব নেই। ইসলামে জবরদস্তির কোন সুযোগ নেই।


বাঙালী মুসলমানদের কাছে ইয়াকুব আলীর ভাষায়, ও পুষ্পের যাহা সুরভি, পল্লবের যাহা শ্যামলিমা, দিগন্ত বিস্তৃত অসীম আকাশের যাহা নীলিমা, ইসলাম মানবাত্মা তাহাই। গোলাম আযম ইসলামের নামে সোনার বাংলায় আজাব ও গজব এনেছেন। যে সুফি-ইসলামের সৌন্দর্য বাংলার কোমল প্রান্তরে সোনালী রোদ্দুরের মত ছড়িয়েছিল মওদুদী-গোলাম আযম ও তাদের খুনী জঙ্গিরা তাকে অগণিত সরল মানুষের রক্তে ভাসিয়ে দিয়েছে। তারা বাংলাদেশ ও বাঙালীকে আজ পর্যন্ত সুস্থির হয়ে দাঁড়াতে দেয়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় উন্নয়ন পরিবেশ রচিত হয়নি, তৈরি হয়নি কোন অভীষ্ট লক্ষ্য। আল্লাহ্র আইন ও শরীয়ার কথা বলে মানুষের সকল উদ্যম ও সৃজনশীলতাকে তারা অর্থহীন বলে প্রচার করে চলেছে। এই সর্বনাশা রাজনৈতিক ইসলামের আজাব থেকে নিষ্কৃতির পথ দেখিয়েছেন হাসান মাহমুদ তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত বই ‘ইসলাম ও শারিয়াহ্’তে। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দলিল ধরে ধরে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন ইসলাম কি চায় ও শারিয়া কি করে। কোরানের আলোকে তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন হিল্লা-বিয়ে, মুরতাদ ঘোষণা, অনিয়ন্ত্রিত বহুবিবাহ ইত্যাদি প্রথা কেন কোরান-বিরোধী। একটি দীর্ঘ অনুপ্রাণিত বক্তৃতার মত, অসাধারণ তেজস্বী ভঙ্গিতে লেখা এ ক্ষুদ্র বইটি ধার্মিক-অধার্মিক, মুসলমান-অমুসলমান, জামাতে ইসলামী, ছাত্র শিবিরসহ সকল রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, স্কুলকলেজ এমন কি মাদ্রাসার ছাত্রসহ লেখাপড়া জানা প্রত্যেক মানুষের পড়া উচিৎ। বইটি ঢাকায় নিউমার্কেটে আলী ব্রাদার্স লাইব্রেরীতে পাওয়া যেতে পারে। মুসলিম লীগ থেকে ক্রমাগতভাবে অগ্রসর হয়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পতাকা উচ্চে তুলে যে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা এনে দিয়ে আজ আবার নিজেদের উপর আস্থা হারাতে বসেছে, ইসলাম ও শারিয়া বইটি তাদের সম্বিত ফিরিয়ে আনবে। ইসলাম যে রাজনীতি নয় এ কথাটা জানা হলে বিএনপি গণতন্ত্রের একটা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে। তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মিলিত গণতান্ত্রিক শক্তির কাছে ইসলামের নামে দাঁড়ানো অপশক্তিগুলি বাংলার মাটি থেকে অবশ্যই উ
খাত হয়ে যাবে। এই বইটি লিখে হাসান মাহমুদ বাংলাদেশের জন্য শেষ যুদ্ধই করেছেন। ধর্ম রাজনৈতিক বিষ হয়ে মানসলোকে ঢুকে পড়ায়, বাঙালী প্রতিভা বন্ধ্যা ও নিষ্ফলা হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক ইসলামই বাংলাদেশের সকল পরাজয়, অধঃপতন ও দুঃখের মূল কারণ। রাজনৈতিক ইসলামের কারণেই বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদের থাবা থেকে বাঁচতে পারছে না। বইটির গুরুত্ব অনুধাবন করলে, সরকার ইচ্ছে করলে লেখককে উপযুক্ত নিরাপত্তা দিয়ে বাংলাদেশে আনিয়ে তাঁর সংগে দেশের আলেম-ওলামাদের উন্মুক্ত টিভি বিতর্কের ব্যবস্থা করতে পারে। এ বই ও লেখক সম্বন্ধে আরো জানতে আগ্রহীদের জন্য তাঁর ওয়েবসাইট ও ই-ঠিকানা যথাক্রমে www.banglarislam.com/ এবং  [email protected]

(লেখাটি র আগে ৭ মে, ২০০৭ তারিখে দৈনিক জনকণ্ঠ-এর  চতুরঙ্গ বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে।)


বেলাল বেগ, নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখক। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক প্রযোজক।


 

মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা):  যোগাযোগ – সাইফুর রহমান তপন, ৬/৭, সেগুনবাগিচা; বি/৬, ডোমিনো এল্ডোরাডো, ঢাকা – ১০০০, টেলিফোনঃ ৬৬৬৮৬৪০৪৭১, ইমেইলঃ [email protected], অথব [email protected]  

অথবা,

ঋত্বিক, ৩৪ আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা ১০০০