শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ ও মুক্তমনার নিবেদন মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা)বেরুলো

আলোকিত চিত্তই পারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থার লোকায়তকরণ

এ. এইচ. জাফর উল্লাহ্

অনুবাদ : অজয় রায়

 

শিক্ষার চরম সার্থকতা হল সহিষ্ণুতা- হেলেন কেল্লার (১৮৮০ - ১৯৬৮)

যুক্তরাষ্ট্রের জীবন-কথা লেখিকা এবং প্রভাষিকা হেলেন কেল্লার যিনি জন্ম থেকেই ছিলেন কালা ও অন্ধ, অনুভব করেছিলেন যে প্রকৃত শিক্ষিত মাত্রই সহিষ্ণু ও স্থৈর্যশীলযিনিই বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন তিনিই সাধারণত মোটা দাগে শিক্ষিত মানুষ হিসেবে বিবেচিতকিন্তু এই প্রথাগত শিক্ষা তাকে খুব কম ক্ষেত্রেই প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ করে তোলেআমার কাছে মনে হয় শিক্ষা হল জীবনব্যাপী একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং সাধনাআমার দেখে বেশ ভাল লাগে যে, বাংলাদেশের বেশ কিছু নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তি অন্যদের আলোকিত করার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজ স্কন্ধে বহন করছেআমার তো মনে হয়, শিক্ষার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের মনকে স্বচ্ছ ও প্রশস্ত করতে সক্ষম

 

এমনি এক সময় আমি জানতে পারলাম যে একটি জার্নাল বের হতে যাচ্ছে যার মাধ্যমে আমার মাতৃভূমির মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা নিজেদের মধ্যে উদার মুক্তচেতনা ও ধ্যান-ধারণা নিয়ে আলোচনা করবেন ও ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট হবেন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে; উদ্দেশ্য একটি লোকায়ত সমাজ ও রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে অসহিষ্ণুতার চিহ্ন থাকবে নাএ ধরনের একটি সাময়িকীর অভাব অনেকের মধ্যে অনেকদিন ধরে অনুভূত হচ্ছিলএই সুযোগে আমি, এ ধরনের উন্মুক্ত বাদানুবাদের একটি অধ্যায় সূচনার উদ্যোগ নেয়ায় শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ ও মুক্তমনাকেএকই সাথে আমার উষ্ণ অনুভূতি এবং অভিনন্দন জানাই

অনেকে হয়তো ভাবতে বসবেন, পশ্চিমী সমাজব্যবস্থার অসামান্য সাফল্য নিয়ে - অর্থা কি করে শতবর্ষের কম সময়ে সমগ্র ইউরোপে ও উত্তর আমেরিকায় লোকায়ত, বৈজ্ঞানিক এবং ন্যায়পরায়ণ সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিলযখন পশ্চিমী সমাজগুলো আধুনিকতার পথ ধরে এগিয়ে চলছে, তখন কেন এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বহু সমাজ বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তার নিরিখে এখনও অন্ধকারাচ্ছন্ন? কুসংস্কারে আবদ্ধ এই সমাজগুলোতে - বহিরাগত ভাব-ভাবনার প্রতি অসহিষ্ণুতা, অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং সংকীর্ণতার প্রবৃদ্ধি নিত্যকার ঘটনা, ব্যাতিক্রম নয় পশ্চিমী সমাজ-সংস্কৃতি-পরিবেশে উন্মুক্ত হল অনুসন্ধিসার দরজা; কিন্তু কী করে এটি সম্ভব হল? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায়

 

মধ্যযুগে সমগ্র ইউরোপব্যাপী খ্রিস্টধর্ম ছিল একটি প্রবল শক্তি১৫শ ও ১৬শ শতকে ইউরোপের স্ব স্ব দেশে ও ভ্যাটিকানে ক্যাথলিক চার্চ ছিল অপ্রতিরোধ্য ও প্রভূত ক্ষমতাবানএ সময় ক্যাথলিক চার্চের বা তার অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃত্বের বিরোধিতা করার অর্থ ছিল ধর্মদ্রোহিতার সামিলকিন্তু পরিণামে খ্রিস্টধর্মে সংস্কার এসেছিল, সংঘটিত হয়েছিল এর বিরুদ্ধে দ্রোহ খ্রিস্টিয় ১৫২০-১৫৪৬ সাল ধরে যখন সম্রাট জহিরুদ্দিন বাবর উত্তর ভারত জয় করে ইতোমধ্যে মোগল রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ঠিক সে সময় মার্টিন লুথার নামের এক ধর্মতত্ত্ববিদ মধ্য ইউরোপে ধর্ম সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেনপোপের ধন সঞ্চয় ও দুর্নীতির বিরোধিতা, এবং তাঁর বিশ্বাস যে আনুগত্যের মধ্য দিয়েই আসে চরম মুক্তি, অন্য কোন কর্মসাধনে নয় - এই ছিল তাঁর সংস্কার আন্দোলনের মূল কথাএই সংস্কার আন্দোলন তাঁর ওপর প্রতিষ্ঠিত ক্যাথলিক কর্তৃত্বের বিরাগ ও বিরক্তির উপাদন করেছিলফলে ক্যাথলিক চার্চ থেকে তাঁকে নির্বাসিত করা হয় ১৫২১ খ্রিস্টাব্দেতিনি ১৫৩০ সালে কার্যকরভাবে লুথারীয় চার্চ স্থাপনার মধ্য দিয়ে প্রবল সংস্কার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, যা সে কালের পশ্চিমী বিশ্বকে প্রচ- ধাক্কা দিয়েছিলএ ধরনের প্রাথমিক কিছু আঘাতকারী ঘটনা ধর্ম সংস্কারের ইতিহাসে অনুঘটকের কাজ করেছিল, আর এর পথ ধরেই খ্রিস্টিয় ধর্ম জগতে আরও স্থায়ী সংস্কার সাধিত হতে থাকে

 

অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে পশ্চিম ইউরোপে সমাজ সংস্কারের আন্দোলন ক্রমশ তীব্রতর হতে থাকে যার ফলে ১৭৮০র দশকে ফ্রান্সে ঘটে জনগণের প্রবল উত্থান; এর আগে ১৭৭০-দশকের সংঘটিত হয় আমেরিকান বিপ্লবএ দুটি ঘটনা বিশ্বকে দ্রুত চালিত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এবং রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের ধ্বংসস্তূপের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় সম সমাজ ব্যবস্থাগোটা ১৯ শতকে পশ্চিম বিশ্ব এক আলোকিত পুনরুভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, যে কালপর্বে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে ফ্রানকোয়েস ম্যারি আরওয়ে , ভিক্টর হুগো , ভলতেয়ার  এবং চার্লস ডিকেন্স প্রমুখের মত একঝাঁক বিস্ময়কর লেখক ও প্রতিভাধর মুক্ত চিন্তাবিদের আভির্ভাব ঘটেছিল অন্যদিকে তাঁরা ছিলেন সমাজ সংস্কারও

 

আমেরিকার মত শুদ্ধচিত্ত সমাজেও, নয়া প্রজন্মের একদল লেখক ও চিন্তাশীল ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে যাদের প্রভাব সমাজে অনুভুত হতে থাকে - ফলে চার্চের প্রভাব থেকে সমাজ মুক্ত হতে থাকেআমি এই মুহূর্তে রালফ্ ওয়ালদো এমারসনের  কথা মনে করতে পারি, যিনি তাঁর তীক্ষè সমালোচনামূলক প্রবন্ধাদির মাধ্যমে হয়ে উঠেছিলেন আমেরিকান তুরীয়বাদের মধ্যমণিতাঁর কবিতা, বক্তৃতা, এবং বিশেষ করে প্রবন্ধসমুহ - যেমন প্রকৃতি (Nature, ১৮৩৬), আমেরিকান চিন্তাধারার উন্নয়নে ও সাহিত্যের বিকাশে মাইল ফলক হিসেবে বিবেচিত হয়কাজেই সব বিবেচনায় উনবিংশ শতাব্দী ছিল সর্বোকৃষ্ট সময় যখন মনুষ্যত্ব তার সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে ধর্মের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করেছিল

 

পশ্চিমের জগতে যখন এসব কর্মকা  চলছিল সে সময় আমাদের গ্রামীন সমাজের সামন্ততান্ত্রিক চরিত্রের কারণে ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত ইউরোপের এই আলোকায়ন-আন্দোলন আমাদের সমাজের, বিশেষ করে নগর ভিত্তিক উচ্চ শ্রেনীর সামান্য অংশকে স্পর্শ করেছিল মাত্রযাঁরা চিত্তবিকাশের এই অমৃতের সামান্য স্বাদ পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন ছিলেন : রাজা রামমোহন রায়, দ্বারকা নাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর, কেশব চন্দ্র সেন, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত .. ..এই জ্ঞানবান ও মুক্তমনের বাঙালীরা কেবলমাত্র বাংলাদেশের নয় সমগ্র উপমহাদেশের ভবিষ্য নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন   

                                                            

বাংলার পূর্বাঞ্চলের দিকে আলোচনার মুখ ফেরান যাক, যে অংশটি অবশেষে বাংলাদেশ রাষ্ট্র নামে আবির্ভুত হয়প্রশ্ন হল ইংরেজ শাসনাধীনে দেশ বিভাগ পূর্বকালের দিনগুলোতে (১৯৪০ ও তপূর্বে) এই পূর্ববঙ্গের প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষের জীবনকে এই আলোকিত হওয়ার আন্দোলনের বাতাস কতটা স্পর্শ করেছিল? সে সময় আমাদের দেশের মানুষের শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ বাস করত গ্রাম-গঞ্জে; খোদ ঢাকা শহরেই আড়াই থেকে তিন লাখ লোকের বাস ছিলআমাকে যদি অনুমান করতে বলা হয় এদের মথ্যে কত জন ইঊরোপীয় আলোকের ঝিলিক দেখেছিল, আমি বলব ০.১% এর বেশী কিছুতেই নয়আমি অবশ্য নিজে সৌভাগ্যবান যে আমি এমন একটি পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলাম যার সদস্যরা উনবিংশ শতাবদীর প্রথম দিকের বাংলার পুনর্জাগরণের আলোয় কিঞ্চি উদ্ভাসিত হয়েছিলআমার মাতামহ ছিলেন শ্রীহট্ট শহরের (আরবীয় নাম সিলেট) একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীতাঁর ছেলেমেয়েরা সেক্যুলার স্কুলে পড়াশুনা করেছিল; অন্যদিকে পরিবারটি ছিল সঙ্গীত. শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চায় নিবেদিতআমার মামারা কোলকাতা থেকে বের হওয়া আধুনিক গ্রামোফোন রেকর্ডের গান নিয়মিত শুনতেনছেলে মেয়েরা এ ধরণের উদ্দীপনাময় পরিবেশে বেড়ে ওঠায় তাদের জীবনে ধর্মের প্রভাব ছিল সামান্যইআমার পিতৃদেবের পরিবার অবশ্য অতটা ভাগ্যবান ছিলেন না, কারণ তারা গ্রামে বাস করততবে আমার পিতৃদেব অতি অল্প বয়সেই বাড়ী ছেরে চলে গিয়েছিলেন স্কুলে পড়তে, এবং পরবর্তীকালে শ্রীহট্টের মুরারী চাঁদ কলেজ থেকে ১৯২৭ সালে বি.এ পাশ করেছিলেন

 

আমার শৈশব কালে বড়দের কাছে সামান্যই ধর্মীয় উপদেশ বা নির্দেশনা পেয়েছিলামবরং এর পরিবর্তে, স্কুলের ফর্মাল শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে সঙ্গীত - সনাতনী, রবীন্দ্র-নজরুল, আধূনিক .., নাটক, সাহিত্য প্রভৃতিকে ঘিরে আমার জীবন গড়ে উঠেছিল স্বভাবতই খোলা মন নিয়ে প্রশ্ন করার পরিবেশ গড়ে উঠেছিল আমাদের বাসায়এ ধরণের উন্মুক্ত প্রতিবেশ ও পরিবেশে আমার শিশুমন বিকশিত হচ্ছিলপাঠককে জানাতে আমার কোন দ্বিধা নেই যে আমার এই পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য আমাকে ধর্মের পথে বাতাস তাড়িত করে নিআমরা ছিলাম শৈশব থেকেই ধর্মনিরপেক্ষতার শক্ত মর্মঢাকায় বড় হওয়ার কালে ৫০ ও ৬০ এর দশকগুলোতে গুলিস্তান ও নাজ প্রেক্ষাগৃহে প্রাতঃকালীন প্রদর্শনীতে ছিলাম নিয়মিত সিনেমা যাত্রীসেকালে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে তৈরী এসব চলচ্চিত্রের উদার আবেদন ছিল আমাদের কাছেধর্মীয় পুস্তকের পরিবর্তে বাসায় দেশ, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, টাইম, নিউজউইক প্রভৃতি আমরা গোগ্রাসে গিলতে চেষ্টা করতামএর ফলে আমাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর মুক্ত আবহাওয়ার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়েছিল

আমাদের কালে শিশুদের অনেকেই এতটা ভাগ্যবান ছিল না, এটিও আমার দৃষ্টি এড়ায় নি অধিকাংশ ছেলেমেদের ইসলামিয়াতের বেশ ভাল মাত্রা হজম করতে হতআমার মনে হয় এদের অধিকাংশই গভীর সংশয়ের মধ্যে পড়তস্কুলে লোকায়ত শিক্ষার প্রকৃতি এবং বাসায় ইসলামী শিক্ষার আবহ-  এই দুই বৈপরত্যের মধ্যে বেড়ে ওঠার কারণে শিশুমনে সংশয় সৃষ্টি হত, যা পরবতী জীবনেও গভীর ছাপ রেখে যেতএকটি উদাহরণ দেয়া যাক, ডারউনের বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টি কথার পুস্তকের মধ্যে, যে পুস্তকে বলা হয়েছে ৬ দিনে ঈশ্বরের ইচ্ছায় মনুষ্য সৃষ্টির কাহিনী, যে অসামঞ্জস্য বিদ্যমান এর ব্যাখ্যা কী ভাবে সম্ভব? বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও আদম-ইভের সৃষ্টির কথার পার্থক্যের মধ্যে মীমাংসা করা কে কী উপায়ে করবে? বাইবেল ও কোরানে বলা হয়েছে যে পৃথিবী সমতল ভূমিএই বক্তব্যের সাথে আধুনিক ভূগোলের মতের সাথে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করুনকোরান বলে যে দিনের কাজের শেষে সূর্য রাতে নিদ্রামগ্ন হয়কিন্তু ধরিত্রী বিজ্ঞান বলে যে সূর্য সব সময় আকাশে বিদ্যমানপাঠক কল্পনা করুন একজন ব্যক্তির মনে ধর্মগ্রন্থগুলো কীভাবে সংশয় সৃষ্টি করে থাকে

 

অন্ধকার যুগের পর বিশ্ব অনেক দূর এগিয়ে এসেছে ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের উদ্ভাসনের প্রভাব গভীরভাবে বা অনুভাবনীয়ভাবে পুরাতন বাংলার পশ্চাভূমিতে অনুভূত হয় নি কোলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রাম .. ইত্যাদি শহরে উনবিংশ শতাব্দীতে পাঠাগার ও গ্রন্থাগার হয়তো ছিল, কিন্তু গ্রামে গঞ্জে কী অবস্থা বিরাজ করত ? সে তুলনায় অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে অবশ্যইআমরা আধুনিক কালকে সত্যিই বলে থাকি তথ্যের যুগকাজেই এটি কোন দুরারোহ কাজ নয়- গ্রাম বাংলাকে তথ্য ভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত করা।  

আমরা যদি সমাজকে জ্ঞানের ভিত্তিতে পরিবর্তন করতে পারি তাহলে প্রায় স্বতঃভাবেই এটি ধর্মনিরপেক্ষ লোকায়ত সমাজে রূপান্তরিত হবে সেক্যুলার বা লোকায়ত সমাজ হল উন্মুক্ত, ঠিক প্যারোকিয়াল  বা সংকীর্ণ সমাজের বিপরীত- যে সমাজ অন্ধ ধর্মবিশ্বাস ও কুসংস্কারে পুরো নিমজ্জিতপ্রথম দিকে বাংলাদেশ লোকায়ত আদর্শের পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছিল, কিন্তু মধ্য ১৯৭৫এর পর থেকে গত ৩০ বছর ধরে আমাদের সমাজের সেক্যুলারিজমের দিকে অভিযাত্রা পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছেএর অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে, জাতি পেয়েছে কতিপয় প্রজন্মের কিশোর, যারা উন্মুক্ত ও লোকায়ত ব্যবস্থার অনুপম সৌন্দর্যের আস্বাদন থেকে বঞ্চিত হয়েছেজাতির অভ্যন্তরে মনে হয় রাজনীতিতে দ্রুত পরিবর্তনের আবহ সৃষ্টি হচ্ছে২০০৬ সালের অক্টোবরের আগে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল ভোটের ব্যাপারে ধর্মান্ধ জনগণের বিরাগভাজন হতে সাহসী হত না পাছে ভোট ব্যাংকের ক্ষতি হয়যে সময়ে অনেক রাজনৈতিক নেতা দুর্নীতির দায়ে জেলে বাস করছেন এবং সমাজে সংস্কারের দাবী অনুভূত হচ্ছে, আমার মনে হয় একটি নতুন সুযোগ এসেছে যা আমাদের দ্বারে করাঘাত করছে

 

সমাজের সর্বস্তরে সেক্যুলারিজমের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে সর্বাধিকসমাজ জীবন থেকে কুসংস্কার, গণকার, ফকির. দরবেশ, সাধু, সন্ত .. ইত্যাদির প্রভাব নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে, এবং এদের স্থানে গুরুত্ব পাবে সুন্দর শিক্ষা-মূল্যবোধ যার মূলে থাকবে গণিত, লজিক, বিজ্ঞান ও মানবিক বিষয় .. .. নিয়ে গড়া একটি সুন্দর ও সুষম শিক্ষা কার্যক্রম অন্যকোন শিক্ষা ব্যবস্থা নয়, কেবল লোকায়ত বা সেক্যুলার শিক্ষাই বাঙালী সমাজের সত্যিকার রূপান্তর ঘটাতে পারে

 

আমরা একটা কাজ করতে পারিএ বছর যে সব ছাত্রছাত্রী কওমী মাদ্রাসা বা এ ধরনের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে তাদের প্রতি একটা আন্তরিক আবেদন জানাই তাদেরকে বলি ঐ সর্বনাশা পথ পরিহার করে সাধারণ সেক্যুলার শিক্ষায়তনে ভর্তি হয়ে জীবনে অন্ততঃ একবার লোকায়ত শিক্ষার অমৃতের স্বাদ নিতেএই শিক্ষা অন্তত একটি কাজ করতে পারে - আর তা হল শিক্ষার্থীর মনকে উদার ও উন্মুক্ত করাতেআর একটি কথা, বিভিন্ন কিছিমের মাদ্রাসা মক্তবের এই বিপুল আয়োজন দেখে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে বাংলাদেশে কতজন মোল্লার দরকার হয় ? লোকায়ত বা সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থাই আজকের দিনের সর্ব্বোচ্চ দাবীসমাজ থেকে অবশ্যই অসহিষ্ণুতাকে বিতাড়ন করতে হবে - কারণ অসহিষ্ণুতাই হল অগ্রগতি ও আধুনিক সমাজ নির্মাণের বড় প্রতিবন্ধক

 


ড. এ. এইচ. জাফর উল্লাহ্ একজন নিষ্ঠাবান গবেষক, কোষ ও অনুজীববিদ্যায় বিশেষজ্ঞ - তাঁর বর্তমান গবেষণার ক্ষেত্র প্রোটিন রসায়ন ও এনজাইমোলজি। ষাটের দশকে বাংলাদেশ কৃষিবিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েট হয়ে তিনি ঢাকা আণবিক শক্তি কেন্দ্রে গবেষণার সূত্রপাত করেন। পরবর্তীকালে জাফর উল্লাহ যুক্তরাষ্ট্রের (ওহিও) সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ. ডি লাভ করেন ১৯৭৪ সালে। আমেরিকা প্রবাসী এই বিজ্ঞানী বর্তমানে নিউ অর্লিয়েন্সে ইউএসডিএ  গবেষণা কেন্দ্রে ১৯৮৫ থেকে এনজাইম ফাইটাস নিয়ে গবেষণা করছেন। এই গবেষণার ফলে মুরগী ও অন্যান্য গৃহপালিত জীবের খামারে ফসফেট দূষণের মাত্রা লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। তাঁর গবেষণার ফসল ফাইটাস এনজাইম বাণিজ্যিকভাবে উপাদিত হতে শুরু করে যার বাসরিক বাজার মূল্য ৫০০ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার। তিনি একজন সুপরিচিত কলাম লেখক -বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের সংবাদপত্রে নিয়মিত লিখে থাকেন। ইন্টারনেট সার্কেলেও তিনি একটি পরিচিত মুখ ও মুক্তমনার উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য। ই-মেইল : [email protected]

 


 

মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা):  যোগাযোগ – সাইফুর রহমান তপন, ৬/৭, সেগুনবাগিচা; বি/৬, ডোমিনো এল্ডোরাডো, ঢাকা – ১০০০, টেলিফোনঃ ৬৬৬৮৬৪০৪৭১, ইমেইলঃ [email protected], অথবা [email protected]  

অথবা,

ঋত্বিক, ৩৪ আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা ১০০০