পরকালের পরাবাস্তবতা
আশা জেগে রয় চিরন্তনবিজ্ঞান, পরলোক এবং জীবনের অর্থ
মূলঃ মাইকেল শারমার
ভাষান্তরঃ ফরিদ আহমেদ
[আমার ভয়াবহ অপছন্দের কাজের মধ্যে একটা হচ্ছে অনুবাদ করা। পারতপক্ষে এই রাস্তায় হাঁটা চলাই করি না আমি। এর পিছনে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। প্রায়শই দেখা যায় যে, কোন এক ভাষার অতিশয় উপাদেয় জিনিষ অন্য ভাষায় অনুবাদের পর হয়ে গেছে লবণ- মসলা বিহীন তরকারীর মত পানস এবং স্বাদহীন। শুধু স্বাদহীনই নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনুবাদের পর তা হয়ে দাঁড়ায় ঘন ঘন স্পিড ব্রেকার লাগানো রাস্তার মতো উঁচুনিচু অমসৃন। পাঠককে প্রবল ঝাঁকি খেতে খেতে হাঁচড়ে পাঁচড়ে এগোতে হয় সেই রাস্তায় সীমাহীন বিরক্তি নিয়ে। ভিন্ন ভাষার লেখাকে কুড়মুড়ে সুস্বাদু এবং মসৃন গতিশীলে রূপান্তর করা যে কতখানি ঘাম ঝরানো কঠিন কাজ তা সেটা যে না করেছে তার পক্ষে বোঝা বড় কষ্টকর। আর ঘাম ঝরানো সব কাজের প্রতি আমার অনীহা প্রবল বলেই খুব সযত্নে অনুবাদ থেকে শতেক হস্ত দূরে থেকেছি এতদিন। তবে সেটা আর পারা গেল না এক হতচ্ছাড়া বিটকেলের জন্য। এই বিটকেলটা আর কেউ না। সে হচ্ছে অভি, আমাদের অভিজিৎ রায়।
মাতৃগর্ভ থেকেই বাঁকা ঘাড় নিয়ে জন্মানোর কারণে আমাকে দিয়ে আমার অপছন্দের কাজ করিয়ে নেওয়াটা যে কারো জন্যেই মোটামুটি অসম্ভব একটা ব্যাপার। তা সে যত অনুরোধ আর কাকুতি মিনতিই করা হোক না কেন। অনুরোধে ঢেঁকি যে খুশি গিলুক, যত খুশি গিলুক, কিন্তু আমি গিলবো না এটাই হচ্ছে আমার ধনুর্ভঙ্গ পণ। আমি যে অনুরোধে ঢেঁকি গিলি না সেটা কীভাবে কীভাবে যেন জেনে গেছে অভি। আর সে কারণেই কোন কাজ করানোর প্রয়োজন থাকলে আলগা তোয়াজ বাদ দিয়ে মাত্র এক লাইনের একটা মেইল দেয় সে, ‘এইটা একটু কইরা দ্যান তো’। তারপরই বড়সড় একটা দম নিয়ে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য গভীর সাগরে ডুব দেয়ে। আঁতিপাঁতি খুঁজেও তার টিকিটির সন্ধান খুঁজে পাওয়া যায় না তখন আর। ডেডলাইনের আগ দিয়ে ঠিকঠিক হুশ করে ডলফিনের মত ভুশ করে ভেসে উঠে সে আবার তার টিকিসমেত। আরেকটা এক লাইনের মেইল আসে তখন, ‘ওই মিয়া, আপনের লেখা কই?’। অবস্থাটা বোঝেন একবার। লেখাটা আদৌ লিখেছি কি লিখি নাই তার কোন খবরই নেই এর মধ্যে। যদি উত্তর দেই, ‘লেখাতো লিখি নাই। পাঠাবো ক্যামনে’? তাহলে অবশ্যম্ভাবীভাবে নির্বিকার উত্তর আসবে, ‘লিখ্যা ফালান। রাইতের মধ্যে পাঠায়া দেন’। এই রকম বিচিত্র অনুরোধে ঢেঁকি তো ঢেঁকি ঢাকেশ্বরী মন্দির পর্যন্ত গলা দিয়ে নেমে যাবে যে কোন লোকের। আমারও সেই একই দশা হয়েছে এবার। তবে কিঞ্চিত সমস্যা হচ্ছে এই যে ঢাকেশ্বরী মন্দিরটা গলা দিয়ে না নেমে সেখানেই আটকে গেছে আমার। কি কারণে সেটা বলছি এখন।
আগেই বলেছি মোটামুটি প্রায় সব ক্ষেত্রেই অনুবাদের পর দুর্দান্ত সব লেখাগুলো হয়ে উঠে ম্যাড়মেড়ে পানসে এবং খরখরে অমসৃন ধরনের। এই সমস্যা দূরীকরণের জন্য অনেক ভাষান্তরকই আক্ষরিক অনুবাদ না করে ভাবানুবাদ করে থাকেন। কেননা, একেক ভাষায় বাক্য গঠন, ভাব প্রকাশ একেক রকম। যা সেই ভাষার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আক্ষরিক অনুবাদ দিয়ে সেই জটিল বিষয়গুলোকে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। সেই ভাষা, সংস্কৃ্তি এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকাটা অনুবাদকের জন্য ভীষনভাবে জরুরী। একইসাথে জরুরী সেগুলোকে অনুবাদকের নিজের ভাষার পাঠকের সামনে বোধগম্য এবং সুস্বাদু উপায়ে পরিবেশন করা। এই জটিল অবস্থা এড়াতে ভাবানুবাদই হয়ে দাঁড়ায় তখন সবচেয়ে ভাল সমাধান। এতে করে ভাষার ছন্দময়তা এবং গতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভবপর হয়। ফলে পাঠকের কাছে তা হয়ে উঠে দারুণ উপভোগ্য এবং অতীব উপাদেয়। তবে ভাবানুবাদের বড় সমস্যা হচ্ছে এক্ষেত্রে অনেক সময়ই অনুবাদক ভাষার মাধুর্য্য এবং গতিশীলতা বজায় রাখতে গিয়ে আসল লেখকের মূল বক্তব্যকে খণ্ডিত বা বিকৃত করে ফেলেন। গল্প, উপন্যাসের ক্ষেত্রে এটা তেমন একটা সমস্যা না, বরং এক ধরনের সুবিধাই বলা যেতে পারে। কিন্তু সিরিয়াস লেখার ক্ষেত্রে বক্তব্যের খণ্ডিকরণ এবং বিকৃতি বড় ধরনের সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। আমাকেও এই প্রবন্ধটি ভাষান্তর করার আগে নিজের সাথে বেশ কিছুক্ষণ বোঝাপড়া করতে হয়েছে কোন পথ বেছে নেবো সেই ব্যাপারে। পরে অবশ্য দুটোকেই পরিত্যাজ্য ঘোষণা করে মাঝামাঝি একটা পথ বেছে নিয়েছি আমি। আমার এই ভাষান্তর আক্ষরিক অনুবাদও না আবার পুরোপুরি ভাবানুবাদও নয়। পাঠক যাতে পলে পলে হোচট না খায় সে কারণে ভাষার মসৃনতা বজায় রাখার জন্য আক্ষরিক অনুবাদ করিনি। আবার শারমারের বক্তব্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার জন্য ভাবানুবাদের পথেও যাইনি আমি। না অনুবাদ, না ভাবানুবাদের বাংলা শব্দ কি হবে? যেটাই হোক না কেন, আমার ভাষান্তর সেই ক্যাটাগরিতেই পড়বে। এই আলগা মাতব্বরির জন্য বিদগ্ধ লোকজনের ভ্রু হয়তো কুঞ্চিত হবে। কিন্তু কি আর করা।
আমার ইংরেজী ভাষা জ্ঞানের চরম দৈন্যতার কারণে (দুঃখের বিষয় আর কি বলবো, বাংলাটাও খুব একটা ভাল জানি না আমি), এই কাজের সাহায্যের জন্য শরণাপন্ন হয়েছিলাম ইরতিশাদ ভাইয়ের। উনার সহযোগিতা ছাড়া না অনুবাদ না ভাবানুবাদের এই সংকর কাজটা সম্পন্ন করা আমার পক্ষে হয়তো সম্ভবপর হতো না। সে জন্য উনার প্রতি রইলো সবিশেষ কৃতজ্ঞতা এবং অনুরাগ। আর অনাবশ্যক এই জটিল কর্মে ঠেলে ঠুলে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য অভির প্রতি রইলো নিদারুণ বিতৃষ্ণা এবং বিরাগ।]
(পর্ব ১)
আমি একবার একটা বাম্পার স্টিকার দেখেছিলাম। তাতে লেখা ছিল,
‘জঙ্গী অজ্ঞেয়বাদীঃ আমি জানি না, তবে আপনিও তা জানেন না’ (Militant Agnostic: I Don’t Know and You Don’t Either)।
পরকাল সম্পর্কে এটাই আমার অবস্থান। আমিও কিছু জানি না, আপনারাও কিছু জানেন না। আমরা যদি নিশ্চিতভাবে জানতাম যে পরলোক বলে কিছু আছে তাহলে মৃত্যুকে এত ভয় পেতাম না। প্রিয়জনের মৃত্যুতে এরকম বুকভাঙ্গা আর্তনাদে মাতম করতাম না আমরা। এমনকি এই বিষয়ে বিতর্ক করারও হয়তো প্রয়োজন পড়তো না।
যেহেতু কেউই নিশ্চিতভাবে জানি না যে মৃত্যুর পর কি ঘটে, সেহেতু আমরা বিষয়টাকে ধর্ম, সাহিত্য, কবিতা, বিজ্ঞান বা হাস্যরসের মত ভিন্ন ভিন্ন উপায় দিয়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করি। সদা উদ্বিগ্ন উডি এলেন এর বিকল্প সমাধান করেছিলেন এভাবেঃ ‘আমি যে মারা যেতে ভয় পাই তা কিন্তু না, তবে যখন মৃত্যু ঘটবে তখন আমি সেখানে থাকতে চাই না’। স্টিভেন রাইটও ভেবেছিলেন যে তিনি এর সমাধান বের করে ফেলেছেন এভাবেঃ ‘আমি চিরকাল বাঁচতে চাই। যত দূর সম্ভব, যত খানি সম্ভব’।
ঠাট্টা তামাশা আপাতত বাদ দেই। যেহেতু আমি একজন বিজ্ঞানী এবং এবং মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ রয়েছে বলে দাবি করা হয় সেহেতু আসুন আমরা সেই সংশয়াচ্ছন্ন ভবিষ্যতের ডাটা বিশ্লেষণ করি এবং তা আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা কি ধরনের অর্থ বহন করে তাই বরং বিবেচনা করি।
একুশ গ্রামঃ আত্মার প্রকৃতি
শারীরিক মৃত্যুর পর মানুষের কি টিকে থাকে বলে মনে করা হয়? এর উত্তর হচ্ছে আত্মা। পৃথিবীতে যত ধরনের ধর্ম বা আধ্যাত্মিক আন্দোলন আছে ঠিক তত ধরনেরই আত্মা সম্পর্কে ব্যাখ্যা চালু রয়েছে। সাধারণ বিশ্বাস হচ্ছে যে, আত্মা হচ্ছে সচেতন চিরন্তন বস্তু যা জীবিতের অনুপম নির্যাস এবং দৈহিক মৃত্যুর পরও তা টিকে থাকে’।
আত্মার প্রাচীন হিব্রু শব্দ হচ্ছে ‘নেপেশ’, বা ‘জীবন’ বা ‘প্রাণশক্তি’। গ্রীক শব্দ হচ্ছে ‘সাইকি’, বা ‘মন’। এবং ল্যাটিন শব্দ হচ্ছে ‘এনিমা’ বা ‘অতিপ্রাকৃত সত্তা’, বা ‘শ্বাস-প্রশ্বাস’। শরীরে স্পন্দন আনা, প্রাণ চাঞ্চল্য আনা এবং জীবনীশক্তির মূল নির্যাস হচ্ছে আত্মা। এটা মোটেও আশ্চর্যজনক নয় যে প্রাকৃতিক জগত সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবের কারণে এই ধারণাসমূহ যখন প্রথম গড়ে উঠছিল, তখন প্রাচীন মানুষেরা মন, শ্বাসপ্রশ্বাস এবং আত্মার মত সাময়িক রূপকের আশ্রয় নিয়েছিল । এই মুহূর্তে ছোট্ট যে কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করছে, উত্তেজনায় লাফালাফি করছে বা আনন্দে লেজ নাড়াচ্ছে, ক্ষণকাল পরে সেই পরিণত হচ্ছে এক খণ্ড অনড় মাংসপিণ্ডে। আসলে কি ঘটছে সেই মুহুর্তে?
আসলে কি ঘটছে সেটা উদঘাটন করার জন্যে ১৯০৭ সালে ম্যাসাচুসেটস এর চিকিৎসক ডানকান ম্যাকডোগাল ছয় জন রোগীর মারা যাওয়ার আগের এবং পরের ওজন নেন। তিনি মেডিকেল জার্নাল American Medicine এ জানান যে ওই সমস্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর আগের এবং পরের ওজনের পার্থক্য ২১ গ্রাম। যদিও তার ওজন পদ্ধতি ছিল খুবই স্থূল ধরনের এবং হেরফেরমূলক এবং কেউই তার ফলাফলের অনুরূপ ফলাফল পরবর্তীতে আর পায়নি, তা সত্ত্বেও আত্মার ওজন হিসাবে ছয় গ্রাম মোটামুটি কিংবদন্তির রূপ পেয়ে যায়। এই গবেষণার আসল তাৎপর্য হচ্ছে আত্মা এমন একটা জিনিষ যাকে পরিমাপ করা যায়। কিন্তু আসলেই কি তা সম্ভব?
বিজ্ঞানে আমরা আমাদের ধারণাগুলোকে নিখুঁতভাবে সংজ্ঞায়িত করি। আমি ‘আত্মাকে’ সংজ্ঞায়িত করি এভাবে, ‘একজন ব্যক্তির মৌলিক গুণাবলীর প্রতিনিধিত্বকারী অনুপম তথ্যের প্যাটার্ন’। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, আমরা মারা যাওয়ার পর আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যের পাটার্নকে সংরক্ষণের কোন মাধ্যম না থাকলে আমাদের মৃত্যুর সাথে সাথে আত্মাও মৃত্যুবরণ করে। ডিএনএ দ্বারা সংকেতলিপিবদ্ধ প্রোটিন দিয়ে আমাদের দেহ গঠিত। কাজেই ডিএনএর বিখণ্ডায়নের সাথে সাথে আমাদের প্রোটিন প্যাটার্ন চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। মস্তিষ্কের মধ্যে বিরাজমান নিউরনের প্যাটার্নের মধ্যে আমাদের স্মৃতি এবং ব্যক্তিত্ব সংরক্ষিত থাকে। কাজেই যখন ওই নিউরনগুলো মারা যায় তখন তার সাথে সাথে আমাদের স্মৃতি এবং ব্যক্তিত্বও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। স্ট্রোক এবং আলযেইমার রোগের মতোই চরমভাবে স্মৃতিকে বিধ্বস্ত করে দেয়, তবে একেবারে পাকাপাকি এই যা।
যেহেতু মস্তিষ্ক নিজে কিছু উপলব্ধি করে না, সেহেতু এটা মানসিক কার্যকলাপকে ভিন্ন উৎসের উপর চাপিয়ে দেয়। অতিপ্রাকৃত অস্তিত্বসমূহ যেমন, ভূত-প্রেত, দেবদূত এবং ভিনগ্রহের প্রাণীদেরকে সত্যিকারের প্রাণী বলে বিবেচনা করা হয়। মরণপ্রান্তিক অভিজ্ঞতাকে অন্তর্নিহিত কার্যকলাপ হিসাবে বিবেচনা না করে বহির্কার্যকলাপ হিসাবে ধারণা করা হয়। একইভাবে, তথ্যের স্নায়বীয় প্যাটার্ন, যা হচ্ছে আমাদের স্মৃতি এবং ব্যক্তিত্ব – আমাদের ‘আমিত্ব’, তাকে আত্মা হিসাবে ভাবা হয়। এই প্রেক্ষিতে, আত্মা হচ্ছে এক ধরনের বিভ্রম।
বিজ্ঞান কি আমাদের রক্ষা করতে পারে?
আমার বিভিন্ন গ্রন্থ এবং প্রবন্ধগুলোতে কীভাবে আমরা মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে পারি সে সম্পর্কে অনেক বৈজ্ঞানিক পরিস্থিতিকে আমি মূল্যায়ন করেছি। তবে এইখানে আমি ২০০৬ সালে লেখা দীপক চোপড়ার বই Life After Death: Burden of Proof এ পরলোকের অস্তিত্বের স্বপক্ষের প্রমাণাদির সর্বশেষ দাবি নিয়ে আলোচনা করবো। দীপক চোপড়ার মতে, ছয় ধরনের প্রমাণের প্রেক্ষিতেই তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ে উপনীত হয়েছেন যে, আত্মা বাস্তব এবং চিরন্তন।
১. মরণপ্রান্তিক অভিজ্ঞতা এবং চেতনার পরিবর্তিত অবস্থাঃ হাজার হাজার লোক আছে যাদেরকে হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে কিন্তু পরবর্তীতে তারা দিব্যি বেঁচে বর্তে উঠেছে এবং পরলোকের কিছু অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছে। এই অভিজ্ঞতাসমূহের মধ্যে আছে শরীর থেকে বের হয়ে ভেসে বেড়ানো, সুড়ঙ্গ বা সাদা আলোর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা, ভালবাসার লোকজন অথবা ঈশ্বর বা যীশুকে দর্শন কিংবা অন্যলোকের কোন স্বর্গীয় বর্ণনা ইত্যাদি। যদি এই রোগীদের মস্তিষ্ক মৃত হয়ে থাকে তবে তাদের সচেতন ‘আমিত্ব’, তাদের ‘আত্মা’ নিশ্চয়ই দেহের মৃত্যুর পরও বেঁচে ছিল।
২. ইএসপি এবং মনের প্রমাণঃ এখানে চোপড়া দূরদর্শন এবং টেলিপ্যাথির জন্য psi গবেষণার উপর নির্ভর করেছেন। এক্ষেত্রে গবেষণায় ব্যবহৃত ব্যক্তিদেরকে একা কোন রুমে আটকে রাখলেও তারা পঞ্চ ইন্দ্রিয় ব্যবহার করা ছাড়াই অন্য কোন রুমে কি ঘটছে তা দেখতে পারে।
৩. কোয়ান্টাম সচেতনতাঃ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগতে দেখা গেছে, পারমানবিক কণাদের গতিবিধির উপর পরীক্ষা-নিরিক্ষা দূরবর্তী অঞ্চলে অনিশ্চিত প্রভাব তৈরি করে, আইনস্টাইন জাকে বলতেন - 'স্পুকি একশন এট এ ডিসটেন্স'। এক স্থানের কণার উপর পর্যবেক্ষণ তাৎক্ষনিকভাবেই অন্য কোন দূরবর্তী (তাত্ত্বিকভাবে বহু দূরের দুই গ্যালাক্সিতেও হতে পারে) স্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কণাকে প্রভাবিত করে। এটা আপাত দৃষ্টিতে আইনস্টাইনের আলোর গতির সর্বোচ্চ সীমার লঙ্ঘন বলেই মনে হয় । চোপড়া এর অর্থ করেছেন এভাবে যে, মহাবিশ্ব এক বিশাল কোয়ান্টাম ক্ষেত্র, যেখানে সব কিছুই (এবং সবাই) আন্তঃসম্পর্কযুক্ত এবং একে অন্যকে সরাসরি এবং তাৎক্ষনিকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। দীপক চোপড়াএবং অন্যেরা কীভাবে মস্তিষ্ক জৈব-রাসায়নিক সংকেতের মাধ্যমে সম্পূর্ণ বস্তুজগতকে প্রতিনিধিত্ব করে তা ব্যাখ্যা করার জন্য কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে প্রয়োগ করেছেন - 'কোয়ান্টাম সচেতনতার মাধ্যমে আমরা হয়তো জানতে পারবো মস্তিষ্ক কীভাবে যাকে আমরা স্বর্গ বলে জানি সেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাল্পনিক জগতসমূহ তৈরি করে থাকে। যদি এই রহস্য মস্তিষ্কের রসায়নের মধ্যে না থেকে বরং সচেতনতার মধ্যে থাকে তবে পরলোক দূর কোন রহস্যময় জগত না হয়ে আমাদের বর্তমান জীবনেরই বর্ধিতাংশ হতে পারে।'
৪. আধ্যাত্মিক মাধ্যম এবং মৃতের সাথে কথোপকথনঃ দীপক আধ্যাত্মিক মাধ্যম এবং তাদের মৃত ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগের আপাত প্রতীয়মান সক্ষমতার উপর করা গবেষণাসমূহের ব্যাপক পর্যালোচনা করেছেন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্ত করেছেন যে তিনি নিজেও এরকম এক গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন। সেই পরীক্ষণে তিনি তার মৃত বাবার সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দীপকের বাবার সাম্প্রতিক মৃত্যুই তাকে এই ধরনের গবেষণা এবং এই বই লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে।
৫. প্রার্থনা এবং রোগ নিরাময় গবেষণাঃ চোপড়া ফলদায়ক দূরবর্তী প্রার্থনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। রোগীর সুস্থতার জন্য অনেক দূর থেকে অজানা ব্যক্তিরা প্রার্থনা করলে, প্রার্থনা না করা রোগীদের তুলনায় তারা অনেক দ্রুত আরোগ্য লাভ করে। এর মূল অর্থ হচ্ছে যে, চিন্তার মাধ্যমে দূর কোন কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কোন দেবতার হস্তক্ষেপেই হোক বা কোন মহাজাগতিক শক্তির কারণেই হোক না কেন এ ধরনের শক্তি প্রদর্শন করা সম্ভব। এর মাধ্যমেই আমরা বিশ্বজগৎ এবং এর অন্তর্ভুক্ত সব কিছুর সাথে সম্পর্কযুক্ত হই।
৬. তথ্য ক্ষেত্র, মরফিক অনুরণন এবং বিশ্বজনীন জীবন শক্তিঃ চোপড়া দাবি করেছেন যে প্রকৃতি তথ্য ক্ষেত্রের মাধ্যমে তথ্য সংরক্ষণ করে থাকে। তিনি এক্ষেত্রে ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী রুপার্ট শেলড্রেক (Rupert Sheldrake) পরিচালিত গবেষণাসমূহের উল্লেখ করেছেন। রুপার্ট শেলড্রেক প্রমাণ হাজির করেছেন যে, কেউ যখন পিছন থেকে কারো দিকে তাকিয়ে থাকে তখন তারা তা উপলব্ধি করতে পারে। কুকুরেরা জানে কখন তাদের মনিবেরা বাড়িতে ফিরছে। দেখা গেছে শব্দজট (crossword puzzle) বেলা গড়িয়ে গেলে সমাধান করা সহজতর, কারণ তখন অনেক লোকই এর সমাধান করে ফেলেছ এবং সে সমস্ত তথ্য প্রকৃতিতে রয়ে গেছে। সব জীবিত সত্তাকে একে অন্যের সাথে সংযোগকারী ‘মরফিক অনুরণন ক্ষেত্র’ দিয়ে এবং আরো অনেক রহস্যময় অতিপ্রাকৃতিক বিষয়সমূহকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তারা বলেন, তথ্যকে সৃষ্টিও করা যায় না বা একে বিনাশও করা যায় না। কেবলমাত্র নতুন প্যাটার্নে পরিবর্তিত করা যায়। কাজেই এই সংজ্ঞা অনুযায়ী আমাদের ‘আত্মা’ হচ্ছে আসলে তথ্যের আধার যা জন্মের আগেও ছিল এবং মৃত্যুর পরেও তা বহাল তবিয়তে টিকে থাকবে অর্থাৎ আত্মা অবিনশ্বর।
মায়ামি, ফ্লোরিডা [email protected]
===============================================
মুক্তমনার মডারেটর, 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক।
লেখাটি আমাদের মুক্তমনার পরবর্তী বই -‘বিজ্ঞান ও ধর্ম – সংঘাত নাকি সমন্বয়?’– প্রকাশিতব্য সংকলন-গ্রন্থের জন্য নির্বাচিত হল - মুক্তমনা সম্পাদক।