পরকালের পরাবাস্তবতা
আশা জেগে রয় চিরন্তনবিজ্ঞান, পরলোক এবং জীবনের অর্থ
মূলঃ মাইকেল শারমার
ভাষান্তরঃ ফরিদ আহমেদ
(পর্ব ২)
দীপক চোপড়ার মতে এই ছয় ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ হাজার বছর আগে বৈদিক ভারতের হিন্দু ধর্মের প্রথম আধ্যাত্মিক নেতা মহাজ্ঞানী মুনি ঋষিরা বর্ণনা করে গেছেন। ‘ঋষিরা বিশ্বাস করতেন যে জ্ঞান জ্ঞানীর কাছে বহিস্থ কিছু নয় বরং তা তার চেতনার মধ্যেই বিদ্যমান থাকে। কাজেই জীবন এবং মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে তাদের কোন বহিরাগত ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই। আমাদের সত্ত্বার নির্যাস হচ্ছে soul (অন্তর্গত সত্ত্বা), যাকে ঋষিরা আত্মা বলতেন। Soul এবং আত্মা হচ্ছে অদৃশ্য স্বর্গীয় ঝলক যা রক্ত মাংসের মধ্যে ঈশ্বরের উপস্থিতি নিয়ে আসে। অন্যদিকে বেদান্তের আত্মা ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; আর এখানেই সবচেয়ে বড় পার্থক্যটা নিহিত। খ্রীস্টীয় soul-এর মতো আত্মা ঈশ্বরের কাছ থেকে আসতে বা যেতে পারে না। মানুষ এবং স্বর্গীয়তার মধ্যে একধরনের ঐক্য রয়েছে’।
আমি স্বীকার করছি যে আমার পশ্চিমা বৈজ্ঞানিক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি কারণে দীপক কি বলতে চাচ্ছে তা সঠিকভাবে বুঝতে দারুণভাবে অসুবিধা হচ্ছে (যা মাঝে মাঝে খুবই হতাশাজনক)। আমি নিশ্চিত যে, আমার কোন ভুল হলে দীপক তা শুধ্রে দেবে। আমি যা বুঝেছি তার সারাংশ এরকম। বিশ্বজগৎ হচ্ছে সময়হীন শক্তির এক দৈত্যাকার সচেতন তথ্য ক্ষেত্র যার অংশ আমরা সকলেই। জীবন এই অন্তহীন সচেতন ক্ষেত্র থেকে সাময়িকভাবে উদ্ভাবিত। তার মতে এই ক্ষেত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরকমঃ ‘ক্ষেত্রটা পূর্নাঙ্গরূপে কাজ করে। দূরবর্তী ঘটনাসমূহের মধ্যে এটা তাৎক্ষনিকভাবে সংযোগ সাধন করে। এই ক্ষেত্র সব ঘটনাকেই স্মরণ রাখে। এর অবস্থান কাল এবং স্থানের ঊর্ধ্বে। এটা সৃষ্টি হয় সম্পূর্ণভাবেই এর নিজের মধ্যে এবং এর সৃষ্টি উদ্ভূত এবং সম্প্রসারিত হয় বিবর্তনীয় দিকে। এটি একটি সচেতন ক্ষেত্র’। চোপড়া বলেছেন যে সুপ্রাচীনকালে ঋষিরা যা আবিষ্কার করেছিলেন তা আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সাথে চমৎকারভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণঃ ‘প্রতিটা ইলেকট্রন, প্রত্যেকটা চিন্তা, সময়ের একেকটা মুহূর্তের মধ্যে বিরাজমান ব্যবধানের কারণে প্রকৃতির প্রতিটি প্রপঞ্চের কাছে সচেতনতার ক্ষেত্র প্রাথমিক’। এই ব্যবধানই হচ্ছে রেফারেন্স বিন্দু, সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুর স্থবিরতা, যেখানে মহাবিশ্বের সকল ঘটনাসমূহ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হয়।
চোপড়ার পরলোকের তত্ত্বে জীবন এবং মৃত্যু সচেতনতার দিকে বা সচেতনতা থেকে শুধুমাত্র ক্রান্তিকাল ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘ আগের মুহূর্তকে অবসান করেই যেহেতু পরের মুহূর্তকে আসতে হয়, সেহেতু মৃত্যু ছাড়া কোন বর্তমান মুহুর্ত নেই’। কাজেই তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ‘আমরা অন্তহীনভাবে পূনর্নির্মিত মহাবিশ্বে বসবাস করি’। মৃত্যুকে ভয় করার কোন কারণ নেই কেননা ‘আমি যা ধারণ করি তা মৃত্যু নয়, বরং আমি কি হতে পারি সেটাই মৃত্যু। আজ আমি নিজেকে দেখছি সময়ের শিশু হিসাবে, কিন্তু আমি হতে পারি অনন্ত সময়ের শিশু’। পরিশেষে চোপড়া উপসংহার টেনেছেন এভাবে যে, ‘ আমরা আমাদের পুরনো পরিচয় অভিজ্ঞতার ‘আমিত্ব’-আত্মার পরিচয়ের কাছে ফেলে দিয়ে এক বিশ্ব থেকে আরেক বিশ্বে চলাচল করি এবং আমরা আমাদের পরবর্তী শরীরে সম্পূর্ণ নতুন এক অনুপম জীবনের উপাদানসমূহ জড়ো করি’।
বাস্তবতা যাচাইঃ বিজ্ঞান আসলে কি বলে
আসুন ফিরে আসা যাক বাস্তবতায়। প্রকৃত সত্য কিন্তু ভিন্ন রকম। গত পঁঞ্চাশ বছরে পৃথিবীতে আনুমানিক ১০৬ বিলিয়ন মানুষ জন্ম গ্রহণ করেছে। এখনকার জীবিত ছয় বিলিওন মানুষকে বাদ দিয়ে এর আগের একশ বিলিওনের সকলেই মারা গেছে এবং তাদের মধ্যে কেউই কখনো দুনিয়াতে ফিরে এসে আমাদের সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত করেনি যে পরলোক বলে কিছু আছে। এই উপাত্তসমূহ অমরত্বের প্রত্যাশা এবং পরলোকের দাবিকে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। তারপরও আসুন একটা একটা করে এগুলোকে পর্যালোচনা করা যাক।
মরণপ্রান্তিক অভিজ্ঞতা এবং চেতনার পরিবর্তিত অবস্থা
পাঁচশ’ বছর আগে ইনকুবি এবং সুকুবির রূপ নিয়ে অশুভ শক্তি তাদের শিকারদের বিছানায় ঘুমন্ত অবস্থায় জ্বালাতন করেছে। দুইশ’ বছর আগে ভূত এবং প্রেতরা সারারাত ধরে হয়রানি করেছে লোকজনকে। গত শতাব্দীতে ধূসর এবং সবুজ বর্ণের ভিনগ্রহের বাসিন্দারা মানুষদের তাদের বিছানা থেকে ধরে ধরে নিয়ে গেছে তাদের মহাকাশীয় গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার করার জন্য। আর এই যুগে এসে মানুষ মুখোমুখি হচ্ছে মরণপ্রান্তিক অভিজ্ঞতার। মুখোমুখি হচ্ছে আত্মা বাবাজীর হরহামেশা শরীরের বাইরে চলে যাওয়া, শরীর থেকে আলাদা হয়ে ভেসে বেড়ানোর ছেলেমানুষি ইচ্ছার। ভেসে ভেসে আত্মা বাবাজী চলে যাচ্ছে কখনো আঙিনার বাইর।, কখনো বা শুধুমাত্র আঙিনা পার হয়েই সন্তুষ্ট থাকছে না। তা চলে যাচ্ছে একেবারে পৃথিবী ছেড়ে মহাশূন্যের অসীম অন্তহীনতায়।
কি ঘটছে এগুলো? এই সকল পরাবাস্তব প্রাণী এবং রহস্যময় প্রপঞ্চসমূহ কি বাস্তবতা নাকি সবটুকুই আমাদের মনের মাধুরী মেশানো কল্পনা? বিজ্ঞানের নতুন তথ্য প্রমাণ ধারণা দিচ্ছে যে এই বিষয়গুলো প্রকৃতপক্ষে মস্তিষ্কের কারসাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। স্নায়ুবিজ্ঞানী মাইকেল পারসিংগার (Miachael Persinger) তার ক্যানাডার সাডবেরিতে অবস্থিত লরেন্টিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে লোকজনদের Temoporal lobe এ চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের প্যাটার্ন তৈরি করে এর সবগুলো অভিজ্ঞতাই তাদেরকে দিতে পেরেছিলেন। আমি নিজেও এরকম এক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম এবং সেই সময় সামান্য হলেও আমার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
একইভাবে, ন্যাচার পত্রিকার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০০২ সালের সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে যে, সুইস স্নায়ুবিজ্ঞানী ওলাফ ব্লাংকে (Olaf Blanke) এবং তার সহকর্মীরা আবিষ্কার করেছেন যে তারা তেতাল্লিশ বছর বয়স্ক এক মৃগী রোগিণীর টেমপোরাল লোবের সঠিক এঙ্গুলার জাইরাসে বৈদ্যুতিক উদ্দীপনার মাধ্যমে শরীর বিচ্যুত অভিজ্ঞতা (Out-of-body experience, সংক্ষেপে OBE)) আনতে সক্ষম হয়েছেন। প্রাথমিক স্বল্প উদ্দীপনায় ভদ্রমহিলা ‘বিছানায় ডেবে যাচ্ছি’ বা ‘উঁচু থেকে পড়ে যাচ্ছি’ ইত্যাদি অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। কিছুটা বেশি পরিমাণে উদ্দীপনার পরে ‘নিজেকে বিছানায় শোয়া দেখতে পাচ্ছি, তবে শুধু আমার পা এবং নিচের অংশ দেখতে পাচ্ছি’ বলেছেন। আরো অধিক উদ্দীপ্ত করার পর ভদ্রমহিলার তাৎক্ষণিক অনুভূতি হলো ‘ওজনহীনতা’ এবং ‘দুই মিটার উঁচুতে সিলিং এর কাছাকাছি ভাসছি’ এরকম।
২০০১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ Why God Won’t Go Away’তে একই ধরনের একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয় যে, গবেষক এন্ড্রু নিউবার্গ (Andrew Newberg) এবং গবেষক ইউজিনি দ্য আকুইলি (Eugene D’Aquili) দেখতে পেয়েছেন যে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এবং ফ্রানসিসকান সন্ন্যাসিনীরা যখন ধ্যান করে তখন তাদের মস্তিষ্কের স্ক্যান Posterior superior parietal lobe এ বিস্ময়করভাবে স্বল্প কর্মচাঞ্চল্য প্রদর্শন করে। Posterior superior parietal lobe কে লেখকদ্বয় Orientation Association Area (OAA) বলে উল্লেখ করেছেন, যার কাজ হচ্ছে শরীরকে বস্তুগত দূরত্ব সম্পর্কে ধারণা দেওয়া ( যে সকল লোকের এই অংশ বিনষ্ট হয়েছে তাদের কোথাও যাওয়ার রাস্তা খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হয়।)। যখন OAA উদ্দীপ্ত হয় এবং সঠিকভাবে কাজ করতে থাকে তখন সত্তা এবং অ-সত্তার মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য থাকে। গভীর ধ্যান বা প্রার্থনার সময় যখন OAA ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে তখন ওই পার্থক্য ঘুচে যেয়ে বাস্তবতা এবং কল্পনা, শরীর অনুভব এবং শরীর বিচ্ছিন্নতার অনুভবের মধ্যকার সীমারেখা ঝাঁপসা হয়ে উঠে। সম্ভবত একারণেই ভিক্ষুরা বিশ্বজগতের সাথে একাত্মতা অনুভব করে বা সন্ন্যাসিনীরা ঈশ্বরের উপস্থিতি টের পায়, কিংবা ভিনগ্রহবাসীদের দ্বারা অপহৃত ব্যক্তিরা বিছানা ছেড়ে উড়ে যেতে থাকে অন্য জগৎ থেকে আসা মূল নভোযানের দিকে।
কারো কারো ক্ষেত্রে কখনো কখনো বড় ধরনের শারীরিক বা মানসিক আঘাতের কারণেও ওই ধরনের অভিজ্ঞতার সূত্রপাত হতে পারে। Lancet এর ডিসেম্বর ২০০১ সংখ্যা একটি ডাচ গবেষণার কথা উল্লেখ করেছে যেখানে ৩৪৪ জন হৃদ্রোগী ক্লিনিক্যাল ডেথ অবস্থা থেকে বেঁচে ফিরে এসেছে। এদের মধ্যে বারো শতাংশ মরণপ্রান্তিক অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছে। মরণপ্রান্তিক সেই অভিজ্ঞতায় তারা তাদের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভেসে বেড়িয়েছে এবং সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আলোর দেখা পেয়েছে। কেউ কেউ আবার সেই সময় মৃত আত্মীয় স্বজনের সাথে টুকটাক সুখ দুঃখের কথা টথাও সেরে ফেলেছে বলে জানিয়েছে।
এই সব ঘটনার সাধারণ ব্যাখ্যা হচ্ছে যে, যেহেতু আমাদের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতার উদ্দীপক বাইরে থেকে মস্তিষ্কে আসে, কাজেই যখন মস্তিষ্কের একটা অংশ মস্তিষ্কের ভিতরেই অস্বাভাবিকভাবে এই বিভ্রম তৈরি করে তখন মস্তিষ্কের অন্য অংশ বহিরাগত বিষয় হিসাবে সেগুলোকে চিহ্নিত করে। ফলে, অস্বাভাবিক বিষয়কে মনে করা হয় অতিপ্রাকৃতিক বিষয় বলে। বাস্তবে এটা কেবলমাত্র মস্তিষ্কের রসায়ন ছাড়া আর কিছুই নয়।
আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, NDE এবং OBE এর মধ্যে জৈব-রাসায়নিক সম্পর্ক রয়েছে। আমরা জানি যে আকাশে উড়ার হ্যালুসিনেশন এট্রোপাইন এবং অন্যান্য বিষাক্ত এলকোয়েডের কারণে ঘটে থাকে। এদের কিছু কিছুকে পাওয়া যায় ম্যানড্রেক এবং জিমসন আগাছার মধ্যে। ইউরোপিয়ান ডাকিনীরা এবং আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ান শ্যামানরা এগুলোকে যত্রতত্র ব্যবহার করতো। কেটামাইনস (Ketamines) এর মত অনুভূতিনাশকের কারণে খুব সহজেই OBE সংঘটন করানো সম্ভব। DMT (dimethyl-tryptamine) জগৎকে সম্প্রসারণশীল বা সংকুচিত হওয়ার অনুভূতির জন্ম দেয়। LSD দৃষ্টিভ্রম এবং শ্রবনভ্রম তৈরি করে অন্যান্য অনেক অনুভূতির মধ্যে বিশ্বজগতের সাথে একাত্মতার অনুভূতির জন্ম দেয়। ওই ধরনের কৃত্রিমভাবে তৈরি রাসায়নিক উপাদানের গ্রহণ উন্মুখ এলাকা থাকার অর্থই হচ্ছে মস্তিষ্কের স্বাভাবিকভাবে তৈরি রাসায়নিক উপাদান কিছু পরিস্থিতিতে ( উদাহরণস্বরূপ, শারীরিক বা মানসিক ভয়ানক আঘাত বা দুর্ঘটনা) মরণপ্রান্তিক অভিজ্ঞতার কোন একটি অথবা সকল অনুভূতিরই বিকাশ ঘটাতে পারে। কাজেই, আজরাইলকে মাথার কাছে দেখার চরম যন্ত্রণা থেকে লাগামহীন ‘ভ্রমনের’ রূপে মরণপ্রান্তিক এবং শরীর বিচ্ছিন্নতার অভিজ্ঞতা হতে পারে।
কেন ভিন্ন ভিন্ন লোক সুড়ঙ্গেরর মত একই ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে সেটা দেখানোর মাধ্যমে মনোবিজ্ঞানী এবং পরাবাস্তব গবেষক সুসান ব্লাকমোর (Susan Blackmore) হ্যালুসিনেশন হাইপোথেসিসকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। রেটিনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য মস্তিষ্কের পিছনের দিকে অবস্থিত ভিস্যুয়াল কর্টেক্সে প্রক্রিয়াজাত করানো হয়। হ্যালুসেনিক ওষুধসমূহ এবং মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব এই এলাকায় স্বাভাবিক স্নায়ু কোষের উৎক্ষেপণের হার এর সাথে ঝামেলা পাকাতে পারে। এটা যখন ঘটে তখন স্নায়বিক কার্যক্রমের ‘ডো্রাকাটা দাগ’ (Stripes) ভিস্যুয়াল কর্টেক্সের দিকে অগ্রসর হয়। এটাকেই তখন মস্তিষ্ক কেন্দ্রীভূত বৃত্ত বা সর্পিল কুণ্ডলী রূপ বলে ধরে নেয়। এই সর্পিলাকার কুণ্ডলীলেই সুড়ঙ্গ হিসাবে হয়তো দেখা যায়। একইভাবে, দেহ বিচ্যুতির ক্ষেত্রে উপর থেকে ভাসমান অবস্থায় দেখার বিষয়টা প্রকৃতপক্ষে স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া ‘বিকেন্দ্রীকরণ’ এর সম্প্রসারিত ধরন। নিজেকে সমুদ্র সৈকতে বসে থাকা বা পর্বত আরোহণ করা কল্পনা করা সাধারণত উপর থেকে নিচের জিনিষ দেখার মত।
মস্তিষ্ক এবং মন যে একই জিনিষ তা এই গবেষণা কর্মগুলোই প্রমাণ। সকল অভিজ্ঞতাই আসলে গৃহিত হয় মস্তিষ্কের মাধ্যমে। কর্টেক্স এর মত বৃহৎ এলাকা টেম্পোরাল লোবের মত ক্ষুদ্র এলাকার কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন করে। এই ক্ষুদ্র এলাকাগুলো আবার এঙ্গুলার জাইরাসের (Angular Gyrus) মত আরো ক্ষুদ্র এলাকাগুলোর স্নায়বিক ঘটনাসমূহের মধ্যে তুলনা করে। এই লঘুকরণ একক নিউরন পর্যায় পর্যন্ত চলতে থাকে। এই পর্যায়ে কোন ব্যক্তি পরিচিত কাউকে দেখতে পেলে তার মস্তিষ্কে ‘দিদিমা নিউরন’ নামে পরিচিত খুব নির্বাচিত কিছু নিউরনসমূহ চঞ্চল হয়ে উঠে। UCLA এর নিউরোসার্জন আইজাক ফ্রিড ( Itzhak Fried) এর সহযোগিতায় ক্যালটেক এর স্নায়ু বিজ্ঞানী ক্রিস্টল কোচ (Christol Koch) এবং গ্যাব্রিয়েল ক্রেইম্যান (Gabriel Kreiman) গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিকে বিল ক্লিন্টনের ছবি দেখানোর পর একটিমাত্র নিউরনকে চঞ্চল হতে দেখেছেন। ‘মণিকা নিউরন’ যে এর খুব কাছাকাছি সংযুক্ত হতে বাধ্য তা বলাই বাহুল্য।
চেতনার স্নায়বিক সম্পর্ক খোঁজার সূত্রপাত হয় এই মৌলিক পর্যায় থেকে। এবং তারপর স্নায়বিক সংযোগের এই সরলতর ব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত চিন্তার জটিল সিস্টেমের বিকাশমান উপাদান খোঁজার জন্য আমরা সেখান থেকে ক্রমশ অগ্রসর হই। আমরা যা প্রত্যক্ষ করি সেটাকে দার্শনিকেরা বলে থাকেন কোয়ালিয়া (Qualia) বা স্নায়বীয় ঘটনাসমূহের সংযোগের কারণে উদ্ভূত চিন্তা এবং অনুভূতির মনোগত অবস্থা। তবে এটা ঠিক এক সময় না এক সময় বিজ্ঞানের নাছোড়বান্দা আচরনের কারণে সচেতনতার গূঢ় রহস্যও সমাধান হয়ে যাবে।
স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিকের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়াটাই অস্বাভাবি এবং অতিপ্রাকৃতের ভবিষ্যৎ। প্রকৃতপক্ষে, অস্বাভাবি এবং অতিপ্রাকৃত বলতে কিছু নেই। আছে শুধু স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক......... আর আছে শুধু কিছু রহস্য যা এখনো ব্যাখ্যা করা যায়নি এই যা।
ইএসপি এবং মনের প্রমাণ
একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে পিএসআই (psi) বা সাইকিক প্রপঞ্চের উপস্থিতি আছে বলে দাবি করা হচ্ছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে সোসাইটি ফর সাইকিক্যাল রিসার্চের মত সংগঠনগুলো গড়ে উঠেছিল psi গবেষণায় কঠোর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য। সে কাজে সহায়তা দেওয়ার জন্য তাদের হাতে বিশ্ব মানের বৈজ্ঞানিকও ছিল। বিংশ শতাব্দীর বিশ শতকে জোসেফ রাইনের ডিউক বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষণ থেকে শুরু করে নব্বই এর দশকে করা ড্যারিল বেম এর কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার মত মাঝে মাঝেই সিরিয়াস একাডেমিক রিসার্চের সুবিধাও পেয়েছে psi।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৪ সালের জানুয়ারী মাসে বেম এবং তার প্রাক্তন ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গ প্যারাসাইকোলোজিস্ট সহকর্মী চার্লস হনর্টন তাদের প্রবন্ধ ‘Does Psi Exist? Replicable Evidence for an Anomalous Process of Information Transfer’ নামকরা রিভিউ জার্নাল Psychological Bulletin এ প্রকাশ করেন। চল্লিশটা প্রকাশিত প্রবন্ধের মেটা-এনালাইসিস (meta-analysis) করে লেখকদ্বয় উপসংহারে পৌঁছেছেন এভাবেঃ
Psi এর পক্ষে প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও (সাফল্যের হার ৩৫ শতাংশ, যেখানে ২৫ শতাংশ হার দৈবক্রমে হওয়াটা প্রত্যাশিত) বেম এবং হনর্টন হায় হুতাশ করেছেন এই বলে যে, বেশিরভাগ একাডেমিক মনোবিজ্ঞানী তথ্য বা শক্তির ব্যতিক্রমী প্রক্রিয়ায় স্থানান্তর, যাকে psi বলা হয় (যেমন, টেলিপ্যাথি বা অন্য ধরনের ইন্দ্রিয়াতীত অনুধাবন, যা বর্তমানে জানা বস্তুগত এবং জৈবিক মেকানিজম অনুযায়ী অব্যাখ্যাত), তার অস্তিত্বকে স্বীকার করেন না।
বিজ্ঞানীরা কেন psi গ্রহণ করেন নাই? বিজ্ঞানের জগতে ড্যারিল বেমের একনিষ্ঠ গবেষক বলে বিরাট সুনাম রয়েছে এবং তিনি psi গবেষণায় পরিসংখ্যানগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ সব ফলাফল প্রদর্শন করেছেন। নতুন তথ্য এবং প্রমাণ হাজির করলে বিজ্ঞানীদের কি তাদের পুরনো মনোভাব পাল্টানোর কথা না? তাহলে কেন সংশয়? সংশয়ের মূল কারণ হচ্ছে, কোন গবেষণার গ্রহণযোগ্যতার জন্য প্রতিরূপযোগ্য (Replicable) ডাটা এবং সামর্থময় (Viable) তত্ত্বের প্রয়োজন, যার দুটোই psi গবেষণায় অনুপস্থিত ছিল।
ডাটাঃ মেটা-এনালাইসিস এবং গ্যাঞ্জফেল্ড কৌশল দুটোই পরবর্তীতে ভয়ংকর তোপের মুখে পড়েছিল। ইউনিভার্সিটি অব অরিগনের রে হাইম্যান (Ray Hyman) বিভিন্ন গ্যাঞ্জফিল্ড পরীক্ষণে ব্যবহৃত পরীক্ষণ ক্রিয়াবিধির মধ্যে অসামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছেন (বেমের মেটা-এনালাইসিসে সেগুলোকে এমনভাবে একত্রিত করা হয়েছে যেন সেগুলো একই ক্রিয়াবিধি অনুসরণ করে।)। ওই রকম ভিন্নধর্মী ডাটা সেটের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত পরিসংখ্যান পরীক্ষাও (Stouffer’s Z) অনুপযোগী ছিল। তিনি টারগেট রান্ডমাইজেশন প্রক্রিয়াতেও ( যে সিকোয়েন্সে ভিসুয়াল টারগেট রিসিভারে পাঠানো হয়।) খুঁত খুঁজে পান। যার কারণে লক্ষ্য নির্বাচন পক্ষপাতদুষ্ট হয়েছিলঃ ‘গবেষণায় সব তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য এসেছিল টারগেটের দ্বিতীয় অথবা তার পরবর্তী উপস্থিতিতে। আমরা যদি প্রথম উপস্থিতির ক্ষেত্রে অনুমানকে পরীক্ষা করি তাহলে দেখতে পাবো যে ফলাফল দৈবর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ইউনিভার্সিটি অব হার্টফোর্ডশায়ারের রিচার্ড ওয়াইজম্যান (Richard Wiseman) তিরিশটারও বেশি গ্যাঞ্জফিল্ড পরীক্ষণ নিয়ে একটি মেটা-এনালাইসিস করেও psi এর কোন হদিস খুঁজে পাননি। ফলে তিনি উপসংহার টানেন এই বলে যে, psi ডাটা প্রতিরূপযোগ্য নয়। বেম তার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ এরকম আরো দশটা গ্যাঞ্জফিল্ড গবেষণা আছে বলে পালটা দাবি করেন এবং সেগুলো নিয়ে আরো কাজ করে তা প্রকাশ করার পরিকল্পনা তার রয়েছে বলে জানান। আর এইভাবেই শুরু হয় ডাটা নিয়ে বিতর্ক যা ডেকে নিয়ে আসে আরো অনেক অনেক যুক্তিতর্ক।
তত্ত্বঃ ভবিষ্যতে যদি আরো তাৎপর্যপূর্ণ ডাটাও প্রকাশিত হয় তা হলেও psi এর ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা সন্দিহান আছেন বা ভবিষ্যতেও থাকবেন। এর পিছনের জোরালো কারণ হচ্ছে যে, psi কীভাবে কাজ করে সে বিষয়ে ব্যাখ্যামূলক কোন তত্ত্ব নেই। যতদিন পর্যন্ত না psi এর অনুগামীরা ব্যাখ্যা করতে পারবেন যে, কীভাবে প্রেরকের মস্তিষ্কে নিউরন কর্তৃক তৈরি করা চিন্তাসমূহ মগজের খুলি ভেদ করে গ্রহীতার মস্তিষ্কে পৌঁছবে ততদিন পর্যন্ত এই সংশয় থেকেই যাবে। এমনকি উপাত্ত যদি দেখায়ও যে psi এর উপস্থিতি আছে, যা ব্যাখ্যার প্রয়োজন ( আমি নিশ্চিত যে তা নেই), তারপরও আমাদের কার্যকারণ সম্পর্কটা প্রয়োজন।
মায়ামি, ফ্লোরিডা [email protected]
===============================================
মুক্তমনার মডারেটর, 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক।
লেখাটি আমাদের মুক্তমনার পরবর্তী বই -‘বিজ্ঞান ও ধর্ম – সংঘাত নাকি সমন্বয়?’– প্রকাশিতব্য সংকলন-গ্রন্থের জন্য নির্বাচিত হল - মুক্তমনা সম্পাদক।