বিজ্ঞানমনস্ক ধারা ধর্মাচ্ছন্ন স্রোতে

ইরতিশাদ আহমদ 

(পর্ব-১) 

বিশ্বাস আর বিজ্ঞানের সহাবস্থান

একটা চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া,  

জনম ভইরা চলতে আছে  

                                          আবদুর রহমান বয়াতী

বিজ্ঞানচর্চা বনাম বিজ্ঞানমনস্কতা 

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কি দ্বিতীয় বছরে আমাদের রসায়নের একটা কোর্স নিতে হয়েছিলকোর্সটা যিনি পড়াতেন, তিনিই ছিলেন পাঠ্য বইটার লেখক বইয়ের ভূমিকায় শেষাংশে স্যার সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করে লিখেছিলেন, অণু-পরমাণু-ইলেক্ট্রন-নিউট্রন-প্রোটনের জটিল জগত সম্পর্কে তিনি যতই জেনেছেন, সর্বশক্তিমান আল্লাহতালার ক্ষমতার এবং বুদ্ধিমত্তার যে সীমা-পরিসীমা নেই তা উপলদ্ধি করে ততই অভিভূত হয়েছেন সৃষ্টির অপার রহস্য জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে যতই তার কাছে উন্মোচিত হয়েছে ততই তিনি মুগ্ধ হয়েছেন সৃষ্টিকর্তার বিস্ময়কর ক্ষমতার পরিচয় পেয়েতিনি বিজ্ঞানী ছিলেন, রসায়নশাস্ত্রে পন্ডিত ছিলেন।  কিন্তু এই ধারায় যারা চিন্তা করেন, বিজ্ঞানী হলেও কি তাদেরকে বিজ্ঞানমনস্ক বলা যায়? যে বিজ্ঞানগ্রন্থটি তিনি রচনা করেছেন, যে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাপদ্ধতির বর্ণনা তিনি নিজেই তার লেখা বইতে দিয়েছেন, তার তোয়াক্কা না করেই তিনি ধরে নিয়েছেন যে, এই বিশ্বব্রহ্মান্ড এবং এর অন্তর্ভুক্ত সবকিছুর নিয়ামক আল্লাহতালা নামক একজন সৃষ্টিকর্তা যে জ্ঞান তিনি বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে অর্জন করেছেন সেই জ্ঞানকে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের শুধু নয়, তার অপরিসীম বুদ্ধিমত্তার নিদর্শন হিসেবে ধরে নিয়েছেতার এই ধারণার ভিত্তিতে আছে বিশ্বাস, কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ নয়এই স্ববিরোধিতার ব্যাখ্যা কি?  

যদি রসায়নবিদ না হয়ে আমাদের শিক্ষক একজন অশিক্ষিত কৃষকও র‌য়ে যেতেন, তাহলেও খুব সম্ভবতঃ তিনি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী একজন পরহেজগার বান্দা হয়েই থাকতেনপ্রতিদিন নিয়মমাফিক সকালে সূর্যোদয় এবং সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখে দেখে রুজি-রোজগারের মালিক খোদাতালার দরবারে শুকরিয়া আদায় করতেনগাছের ফল, ক্ষেতের ফসল আর নদীর জল-মাছ পেয়ে হয়তো গেয়ে উঠতেন, এই সুন্দর ফুল, এই সুন্দর ফল, মিঠা নদীর পানি, খোদা তোমার মেহেরবানী সবাই তো আর আরজ আলী মাতুব্বরের (১৯০০-১৯৮৫)(১) মতো প্রশ্ন তোলেন না, আমি কে? খোদা কি মনুষ্যভাবাপন্ন? কেন তাঁহাকে ধর্মযাজকগণ পার্থিব মানুষের ও তাদের কার্যকলাপের সাথে তুলনা করিয়া জনসাধারণকে বুঝ দেয়ার প্রয়াস পান?” 

দেখা যাচ্ছে, সারাজীবনের বিজ্ঞান শিক্ষা এবং চর্চা আমাদের কেমিস্ট্রি স্যারকে তার আজন্মলালিত ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্তিতো দেয়ইনি, বরং আরো বেশী করে ধর্মের দিকে ঠেলে দিয়েছেযদিও বিজ্ঞান প্রশ্ন না করে এবং সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে সদুত্তর না পেলে কোন কিছুই মেনে না নিতে শিক্ষা দেয় 

প্রশ্ন হচ্ছে, একজন বিজ্ঞানচর্চাকারীর মনে বিজ্ঞান আর বিশ্বাসের এহেন সমন্বয় কিভাবে সম্ভব এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি দীর্ঘ দিন ধরে বটে, কিন্তু নিজের আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে বিশ্বাস আর বিজ্ঞানের সহাবস্থান দেখে দেখে অযৌক্তিক মনে হলেও একেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছি একসময়মেনে নিয়েছি যে, বিজ্ঞানী হওয়া আর বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া এক কথা নয়বিজ্ঞানচর্চা করে বিজ্ঞানী হওয়া যায়, কিন্তু মুক্তবুদ্ধির চর্চা না করলে বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া যায় নাতাই দেখি, বাংলার অধ্যাপক হয়েও একজন মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে পরিত হন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষে, আর একজন বিজ্ঞানী সারাজীবন বিজ্ঞানচর্চা করেও রয়ে যান ধর্মাচ্ছন্ন ধর্ম টিকে থাকে বিশ্বাসে, বিজ্ঞান বিকশিত হয় সংশয়ে; ধর্মের ভিত্তি ঈমানে, আর বিজ্ঞানের মূল সাক্ষ্যপ্রমাণে   

আমেরিকায় আসার পরে এখানেও দেখেছি আপাতদৃষ্টিতে যাদেরকে আধুনিক, চিন্তা-চেতনায় অগ্রসর, উচ্চশিক্ষিত, কুসংস্কার-মুক্ত বলে মনে হচ্ছে সেই আমেরিকানদের মধ্যেও অনেকেই রয়েছে যারা আক্ষরিক অর্থে আদম-হাওয়ার গালগল্পে বিশ্বাস করেন ছয় হাজার বছর আগে ছয়দিনে ঈশ্বর এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন, বিনা প্রশ্নে এধরণের আজগুবি কথাকে পরম সত্যি বলে মানেনএদের দৃষ্টিতে ঈশ্বর বা বিশ্বস্রষ্টা লম্বা দাড়িওয়ালা প্রৌঢ়বয়সের একজন পুরুষ 

এই ধরণের চিন্তার মূল হেত্বাভাস (ফ্যালাসি) হচ্ছে এই যে, সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাসী মানুষ নিজের অজান্তেই সৃষ্টিকর্তাকে মানুষের সীমাবদ্ধতার নিরীখে তুলনা করে ধর্মবিশ্বাসের মূলে রয়েছে এই ধারণা যে, ভগবান বা আল্লাহ বা ঈশ্বর সব বিজ্ঞানীর সেরা বিজ্ঞানী, সব ইঞ্জিনীয়ারের সেরা ইঞ্জিনীয়ার, সব শিল্পীর সেরা শিল্পী, সব ভাস্করের সেরা ভাস্কর, সব গ্রন্থকারের সেরা গ্রন্থকার মানুষের শ্রেষ্ঠ বিকাশ তার সৃষ্টিশীলতায় আর মননশীলতায়তাই মাইকেলএঞ্জেলো, লিওনার্দো দা ভিঞ্চির সৃষ্টিশীলতায় আর আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথের মননশীলতায় আমরা হই বিস্ময়াভিভুতবিজ্ঞানে, প্রকৌশলে, স্থাপত্যে প্রতিভার পরিচয় পেয়ে আমাদের চিত্ত হয় শ্রদ্ধায় অবনত 

এমন কি একজন ঘড়ির কারিগরও হয়ে যান আমাদের প্রশংসার পাত্রসৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাসীরা ঘড়ির সাথে সৃষ্টির তুলনা করতে খুবই পছন্দ করেন কারন ঘড়ির ডিজাইনার ঘড়ির মধ্যে স্বয়ংক্রিয় ভাবে চলার সামর্থ্য ঢুকিয়ে দেন, বা চাবি মাইরা ছাইড়া দেনযা চলতে থাকে জনমভর যা চলছে, তা কেউ না কেউ চালিয়ে দিয়েছেন, এই ধরণের চিন্তা করতেই আমরা বেশি অভ্যস্ত 

প্যালির ঘড়িতত্ত্ব 

ঘড়িতত্ত্বের জনক হচ্ছেন উইলিয়াম প্যালি (১৭৪৩- ১৮০৫)(২) নামের একজন ধর্মযাজক।  প্যালির Natural Theology – or Evidences of the Existence and Attributes of the Deity Collected from the Appearances of Nature প্রকাশিত হয় ১৮০২ সালে প্যালি লিখেছেন,

আমরা যখন একটা ঘড়ির ভিতরটা ভালভাবে পরীক্ষা করি, আমাদের মনে ধারণা জন্মে যে, এর বিভিন্ন অংশগুলির একটার সাথে আরেকটাকে যুক্ত করা হয়েছে কোন উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যকে মনে রেখেএই অংশগুলিকে বানানো এবং লাগানো হয়েছে এমনভাবে যাতে এর মধ্যে গতির সঞ্চার হয়, এবং সেই গতিকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে যাতে ঘড়িটা দিনের ঘণ্টানুযায়ী সময় নির্দেশ করতে পারেযদি, এর বিভিন্ন অংশগুলি ভিন্ন আকারের হতো, অথবা যদি সেগুলো অন্যভাবে একটা আরেকটার সাথে যুক্ত থাকতো, তাহলে এই যন্ত্রটার মধ্যে কোন গতির সঞ্চার হতোনা, বা হলেও যে সময় নির্দেশ করার জন্য এটাকে বানানো হয়েছে ঘড়িটা তা করতে পারতো না ... আমরা অবধারিত ভাবেই ধরে নিতে পারি, ঘড়িটাকে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ বানিয়েছে, কোনও না কোন সময়ে, কোথাও না কোথাও, এক বা একাধিক নির্মাতা, এর নির্মান এবং ব্যবহার সম্পর্কে পূর্ব-পরিকল্পনা করেই এটাকে বানিয়েছে একটা বিশেষ কাজ করার জন্য, আর তা হচ্ছে সময় নির্দেশ করা।    

এই হচ্ছে প্যালির অকাট্য যুক্তি; ধোঁয়ার পেছনে যেমন থাকে আগুন, তেমনি প্রত্যেকটা ঘড়ির পেছনে আছে কারিগর, আর তেমনি এই বিশ্বব্রহ্মান্ডেরও আছে এক নির্মাতা! মজার ব্যাপার, প্যালি বইয়ের নামে এভিডেন্স শব্দটা ব্যবহার করেছেনকোন কিছুর সত্যতা দাবী করতে হলে যে, প্রমা হিসেবে সাক্ষ্য বা এভিডেন্স দরকার (বিজ্ঞানের নীতি অনুযায়ী) প্যালি প্রকারান্তরে তাই স্বীকার করছেনযদিও সাক্ষ্যের (সৃষ্টি, পৃথিবী) সাথে প্রমাণের (স্রষ্টার অস্তিত্ব) সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্যালি লঙ্ঘন করেছেন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিয়ম - অনুমানের ভিত্তিতে কোন প্রমাণ গ্রহনযোগ্য হতে পারেনা, যতক্ষন না পর্যন্ত সেই অনুমানকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যাচ্ছে প্যালির প্রাথমিক অনুমান (hypothesis) হচ্ছে, এই পৃথিবী ডিজাইন করা হয়েছে এই অনুমান যে ভ্রান্ত নয়, প্যালি তা প্রমাণের প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেনিসঙ্গত কারনেই, এখন পর্যন্ত কারো পক্ষেই এটা প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি 

ইদানীংকালেও ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন তত্ত্বের প্রবক্তারা এই ধরণের যুক্তিই দেন এরা বলেন, বিশ্বব্রহ্মান্ড এতই জটিল যে, কোন উচ্চতর শক্তির ডিজাইন ছাড়া এর অস্তিত্ব অসম্ভবতারা বলেন যে, জটিলতাইতো প্রমাণ করে উচ্চতর ক্ষমতার অধিকারী বুদ্ধিমান কোন ডিজাইনার এটা বানিয়েছেন সাধারন চিন্তায় এই যুক্তির অসারতা চট্ করে ধরা পড়ে নাএর সুযোগেই এরা ইন্টেলিজেণ্ট ডিজাইনকে বিবর্তনতত্ত্বের পাশাপাশি বিকল্প তত্ত্ব হিসেবে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন কোন অঙ্গরাজ্যে) স্কুল-কলেজে পড়ানোর দাবী জানাচ্ছেইন্টেলিজেন্স, ডিজাইন, এবং জটিলতা শব্দগুলির ভুল ব্যাখা এবং প্রয়োগের ওপরেই এই তত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছেকোন সাদা জিনিষ দেখে যদি কেউ বলে, জিনিষটা এতই সাদা, এটা দুধ না হয়েই যায় না, আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়না এই বাক্যের বক্তার সাদা জিনিষ এবং দুধ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সীমিত যারা মনে করেন, জটিলতা মানেই ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন তারাও জটিলতা এবং ডিজাইন সম্পর্কে তাদের সীমিত জ্ঞানেরই পরিচয় দেন।   

রিচার্ড ডকিন্স(৩) তাঁর The Blind Watchmakerএ প্যালির ধারনা সম্পর্কে লেখেন,

প্রকৃতিতে (বা Nature-এ) সব কিছুই পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মে চলে যদি ঘড়ির কারিগর কাউকে বলতেই হয়, তবে তা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মাধীন অন্ধ সূত্রগুলি সত্যিকারের ঘড়ি-নির্মাতার থাকতে হয় সম্মুখদৃষ্টি; ঘড়ির বিভিন্ন পার্টস, কল-কব্জা এবং তাদের মধ্যকার সংযোগক্রিয়া ঘড়ি-নির্মাতার ডিজাইন এবং পরিকল্পনার ফলশ্রুতি ঘড়ি-নির্মাতা তার মনশ্চক্ষুতে দেখতে পান এই ঘড়ির ভবিষ্যত কার্যকারিতা ও উদ্দেশ্য ডারউইন আবিষ্কৃত ন্যাচারাল সিলেকশন বা প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া অন্ধ এবং অচেতন এই প্রক্রিয়া  নিজে নিজেই চলে আপাতদৃষ্টিতে জীবনের উদ্দেশ্য আছে মনে হলেও জীবনের অস্তিত্ব ব্যাখ্যাকারী প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার কোন উদ্দেশ্য নাই এই প্রক্রিয়ার কোন মন নাই, মনশ্চক্ষু নাই ভবিষ্যতের জন্য এর কোন পরিকল্পনা নাই, কোন অন্তর্দৃষ্টি নাই, নাই কোন সম্মুখদৃষ্টিও আসলে এর কোন দৃষ্টিই নাই প্রকৃতিতেন্যাচারাল সিলেকশন-এর ভুমিকা যদি ঘড়ি নির্মাতার মতোই হবে, তবে বলতে হয়, এ হচ্ছে এক অন্ধ ঘড়িনির্মাতা 

 

                                                                                            পরবর্তী পর্ব...

৩০ এপ্রিল, ২০০৮

[email protected]


ইরতিশাদ আহমদ পেশায় প্রকৌশলী।    তার লেখাটি আমাদের মুক্তমনার পরবর্তী বই -‘বিজ্ঞান ও ধর্ম – সংঘাত নাকি সমন্বয়?’– প্রকাশিতব্য সংকলন-গ্রন্থের জন্য নির্বাচিত হল - মুক্তমনা সম্পাদক।