বিজ্ঞানমনস্ক ধারা ধর্মাচ্ছন্ন স্রোতে
(পর্ব-২)
মানুষের চিন্তাশক্তির সীমাবদ্ধতা
সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর,
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জটিল ও ‘পারফেক্ট’ ডিজাইন
ডিজাইন যত জটিল হয়, ইঞ্জিনীয়ারিং-এর কলাকৌশল যতই সাধারণ মানুষের বোধগম্যতার আওতার বাইরে হয়, এই শ্রদ্ধা আর প্রশংসার মাত্রা ততই বেশী হয়। আর তাই সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসীদের মতে, সবচেয়ে জটিলতম ঘড়ি, এই বিশ্বব্রহ্মান্ড যিনি বানিয়েছেন সব প্রশংসাতো তারই প্রাপ্য হওয়া উচিৎ। বিশ্বব্রহ্মান্ডের মতো বা প্রাণের মতো ‘জটিল’ ‘সিস্টেম’ ডিজাইন ছাড়া বানানো হয়েছে এবং এই সিস্টেমগুলি কোন ‘পরিকল্পনা’ ছাড়া ‘নিয়মমাফিক’ চলছে এটা মেনে নেওয়া অনেকের পক্ষেই কঠিন। যুক্তিটা হচ্ছে এরকম - বিশ্বব্রহ্মান্ড নিশ্চয়ই বানানো হয়েছে, না বানালে আসলো কোত্থেকে? আর বানানো যখন হয়েছেই, কেউ না কেউ বানিয়েছেন, সেই কেউ না কেউই হচ্ছেন ভগবান। এই ধারণাই হচ্ছে তথাকথিত ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ তত্ত্বের ভিত্তিমূল।
‘জটিল’ ‘সিস্টেম’ ‘পরিকল্পনা’ ‘নিয়মমাফিক’ ‘ইন্টেলিজেন্ট’ ‘ডিজাইন’ এই শব্দগুলি আমরা অর্থাৎ মানুষেরাই উদ্ভাবন করেছি। এগুলো স্বর্গ থেকে কোন আসমানী কিতাবের মাধ্যমে আসেনি। আমাদের ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে যে জগৎ, তাকে আর সে জগতের মধ্যে যে কর্মকান্ড আমরা চর্মচক্ষে প্রত্যক্ষ করছি, তাকে ব্যাখ্যা এবং বর্ণনা করতে গিয়ে আমরা এই শব্দগুলি উদ্ভাবন করেছি। অথচ আমরা আবার এই শব্দগুলিকেই ব্যবহার করছি যে জগৎ আমাদের কাছে এখনো অজানা, রহস্যময় তাকে ব্যাখ্যা করতে। ঘড়িকে তুলনা হিসেবে ব্যবহার করছি, যা আসলে ঘড়ির মতোই নয় তার সাথে। আর নিজেদের আবিষ্কৃত তুলনার অভিনবত্বে নিজেরাই হচ্ছি মুগ্ধ বিস্ময়ে অভিভুত। নিজেরাই নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পনার স্রষ্টা সৃষ্টি করেছি।
ডকিন্স ফ্যালাসিটার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এইভাবে, “পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মাধীন এই পৃথিবীতে বিবর্তনের জটিল প্রক্রিয়া, এমন কি প্রাণের অস্তিত্বও, সত্যিই বিস্ময়কর – অথবা বলা উচিত আপাতঃ বিস্ময়কর; কারণ, বিস্ময় হচ্ছে এক ধরনের আবেগের বহিপ্রকাশ যা মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত, যে মস্তিষ্ক আবার সেই খোদ বিস্ময়কর প্রক্রিয়ারই ফলশ্রুতি”।(৪)
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘সীমার মাঝে অসীমের’ সুর শুনছি, আবার নিজের মধ্যে সেই অসীমের ‘মধুর প্রকাশের’ আধ্যাত্মিক চেতনায় হচ্ছি উদ্ভাসিত। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন কবি ছিলেন, তাঁর কবিতার এই ছত্রটিতে তিনি শুধু যে এক আধ্যাত্মিক উপলদ্ধির অদ্ভুত সুন্দর প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাই নয়; আমাদের অর্থাৎ, মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতাকেও (বলা নিষ্প্রয়োজন, তাঁর নিজের কাব্যভাবনা প্রকাশের সীমাবদ্ধতাকে নয়) ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর অননুকরণীয় রচনাশৈলী দিয়ে। আইনস্টাইনও এই ধরনের আধ্যাত্মিক উপলদ্ধির কথা বলেছেন। বলেছেন যে, যে কোন চিন্তাশীল মানুষ 'সৃষ্টি'র বিরাটত্বে অভিভূত এবং মুগ্ধ হতে বাধ্য। তিনি একে এক ধরনের ‘রিলিজিয়াস’ অনুভূতির সাথে তুলনা করেছেন। ডকিন্স এই প্রসঙ্গে বলছেন, আইনস্টাইন ‘রিলিজিয়াস’ বলতে ধার্মিকতা বোঝান নি, খুব সম্ভবত আধ্যাত্মিকতা বুঝিয়েছেন। ডকিন্সের মতে আইনস্টাইন ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন না।(৫)
কিন্তু জটিলতার অন্য ব্যখ্যাও আছে। বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব (Chaos Theory) অনুসারে, জটিলতা বিশৃঙ্খলা থেকে উদ্ভুত হতে পারে; জটিলতার পিছনে কোন পরিকল্পনা নাও থাকতে পারে। আসলে, পরিকল্পনার অনুপস্থিতিতেই জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। নয় কি? কোন প্রক্রিয়ার উপর নিয়ন্ত্রন না থাকলেই প্রক্রিয়াটা জটিল হয়ে পড়তে দেখা যায়। মনে রাখা দরকার, জটিল কথাটা এসেছে জট থেকে, জট পাকাতে কি ডিজাইন লাগে? বিশৃংখল এবং পরিকল্পনাহীন বিবর্তনই এই বিশ্বে জটিলতার কারণ; এই মতের পেছনে যুক্তি আছে।
বিশৃঙ্খলা তত্ত্বের অন্যতম উদ্ভাবক নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ ইলিয়া প্রিগোজিন, ইসাবেল স্টেঞ্জারস-এর সাথে লেখা তাঁর বই Order Out of Chaos, Man’s New Dialogue with Nature – এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।(৬) মোদ্দা কথা হলো, বিশ্বে; বেশির ভাগ সিস্টেমই উন্মুক্ত, আবদ্ধ নয়, (open systems, as opposed to closed systems); আর উন্মুক্ত সিস্টেমগুলি তাদের পরিবেশের সাথে প্রতিনিয়ত শক্তি, পদার্থ অথবা তথ্য আদান-প্রদান করছে। নিসন্দেহে, জৈবিক এবং সামাজিক সিস্টেমগুলি উন্মুক্ত, এবং তাই এগুলোকে যান্ত্রিকভাবে বুঝতে চেষ্টা করলে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। উইলিয়াম প্যালি ঠিক এই ভুলটাই করেছিলেন, বিশ্বব্রহ্মান্ডকে ঘড়ির সাথে তুলনা করতে গিয়ে।
আবার এটাও মনে রাখার দরকার যে জটিল মানেই ‘পারফেক্ট’ নয়। ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন তত্ত্বের প্রবক্তারা দাবী করেন যে, সৃষ্টি শুধু জটিলই নয়, ‘পারফেক্ট’ও। অথচ, ‘পারফেক্ট’ বলতে আমরা কি বুঝি এ নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি। সেদিন ইন্টারনেটে দেখলাম একজন প্রশ্ন রেখেছেন, খোদাতালা যদি আমাদের পারফেক্ট করেই সৃষ্টি করে থাকবেন, তবে আমরা খৎনা (প্রচলিত কথায় মুসলমানি) করাই কেন? প্রশ্নটা হাল্কা হতে পারে, তবে উড়িয়ে দেবার মতো কি?
ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইনের আর একটা উদাহরণ - আল্লাহতালা আমাদের এমন নিঁখুত এবং সুবিন্যস্ত পৃথিবী উপহার দিয়েছেন যে, ‘লিপ ইয়ার’ দিয়ে ‘ঠিক’ করার পরেও প্রচলিত গ্রেগরিয়ান ক্যালন্ডারে ‘ভুলের’ পরিমান প্রতিদিন প্রায় সাতাশ সেকেন্ডের মতো, অর্থাৎ প্রতি তিন হাজার দুইশত ছত্রিশ বছরে প্রায় একদিন করে। খারাপ ডিজাইনের আরো সব চিত্তাকর্ষক উদাহরণ আছে অভিজিৎ রায়ের চমৎকার লেখা “ব্যাড ডিজাইন”-এ।(৭)
বিবর্তনতত্ত্ব বোঝার সমস্যা
বিবর্তন তত্ত্ব সহজে মেনে নেয়া আমাদের অনেকের পক্ষেই মুশকিল। রিচার্ড ডকিন্সের মতে এর কারণ হচ্ছে,
“মনে হয়, মানুষের মস্তিষ্ক যেন ইচ্ছাকৃতভাবে ডিজাইন করা হয়েছে ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্বকে ভুল বোঝার জন্য - যেন এই তত্ত্বটাকে মেনে নিতে কষ্ট হয়। সৃষ্টিশীল ডিজাইনার হিসেবে আমাদের অর্থাৎ মানুষের বিরাট সাফল্যই আমাদের মস্তিষ্কে মনে হয় ডারউইনতত্ত্বের সহজাত বিরোধিতার জন্ম দিয়েছে। প্রকৌশল আর শিল্পকলার চমৎকার সব সৃষ্টি আমরা প্রতিনিয়তই দেখছি আমাদের চারপাশে। জটিল, বিস্ময়কর এবং অদ্ভুত সুন্দর এই সৃষ্টিগুলি পূর্বপরিকল্পিত মেধাবী চিন্তার অবধারিত ফলশ্রুতি। ডিজাইন ছাড়া জটিল কোন জিনিষের সৃষ্টি সম্ভব হতে পারে, এমন ধারণাতে আমরা অভ্যস্ত নই। স্বাভাবিক এবং সহজাত বুদ্ধি-বিবেচনার বিপরীতে নিজেদের চিন্তার জগতে এক বিরাট উত্তরণ ঘটাতে না পারলে ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২) আর ওয়ালেসের(১৮২৩-১৯১৩) (৮) পক্ষে কিছুতেই বলা সম্ভব হতো না যে, প্রাণের বিবর্তন প্রক্রিয়াকে বোঝার বিকল্প এক পথ আছে; এবং একবার ভালোভাবে বুঝতে পারলে এই পথটাকেই অধিক যুক্তিসঙ্গত মনে হতে বাধ্য। চিন্তার এই উত্তরণ এতই ব্যাপক যে, অনেকেই এখন পর্যন্ত তা ঘটাতে পারেননি নিজেদের মনে”।(৯)
সীমাবদ্ধ চিন্তাশক্তির ফলেই মানুষের মনে সৃষ্টিকর্তার অবয়ব তৈরী হয়েছে একজন ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনারের ইমেজে। ফ্যালাসিটা হচ্ছে মানুষের চিন্তাশক্তির সীমাবদ্ধতাই এই ধরণের চিন্তার বা কল্পনার উৎস। বিশ্বব্রহ্মান্ড বা প্রাণ আমাদের অনেকের কাছে এক বিস্ময়কর মেশিন বা ইঞ্জিন বিশেষ। এজন্যই কল্পিত সৃষ্টিকর্তাকে আমরা মানুষের আদলে চিন্তা করি, মানুষের গুনাবলীর চূড়ান্ত রূপগুলি তাঁর উপর আরোপ করি। শুধু কি গুনাবলীই, আমরা মানুষের দোষ-ত্রুটির চরম প্রকাশও এই কল্পিত সৃষ্টিকর্তার চরিত্রে দেখতে চাই। বলেও থাকি, মানুষের জন্য যা পাপ দেবতাদের বেলায় তাই লীলাখেলা। আমরা ঈশ্বরকে মানুষের মতোই ক্ষমতালোভী রিপুতাড়িত একজন প্রভূ হিসেবে কল্পনা করি। তার মধ্যে দেখতে পাই মানবীয় গুনাবলীর চরমতম বিকাশ, আর দানবীয় রিপুপরায়নতার চূড়ান্ত প্রকাশ। এই প্রভূ পরম করুনাময়, কিন্তু আবার নিয়ন্ত্রন করতে পছন্দ করেন; দারুন নিরাসক্ত, জাগতিক সব চাওয়া-পাওয়ার উর্ধ্বে, কিন্তু আবার স্তুতি-প্রশংসা পেলে ভীষন খুশী হন; মহাপরাক্রমশালী অত্যাচারী রাজা-মহারাজাদের মতো আনুগত্য দাবী করেন এবং না পেলে কঠোর শাস্তি দেন। এই প্রভু মানুষের মতোই তোষামদে তুষ্ট হন, অবাধ্যতায় হন রুষ্ট।
হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ ধর্মীয় চিন্তা-চেতনায় আচ্ছন্ন হয়ে এমনি সব পরস্পর- বিরোধী ধারণায়, কুসংস্কারে এবং আজগুবি কল্প-কাহিনীতে বিশ্বাসী ছিল। এখনো অনেকেই আছেন সেরকম। মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতার জন্যই একসময়ে পৃথিবীর চারিদিকে সূর্য বৃত্তাকারে ঘুরছে ভাবা হতো। এবং বলা হতো এটাই ধর্মের কথা। কিন্তু বিজ্ঞান যখন বললো যে, না ব্যাপারটা আসলে উল্টো, পৃথিবীই ঘুরছে সূর্যের চারপাশে। শুরু হয়ে গেল সংঘাত। পৃথিবী, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র নিয়ে বিজ্ঞান যখনই নতুন কোন ধারণার কথা বলেছে, যখনই নতুন কোন ব্যাখ্যা দিয়েছে, ধর্মবাদীরা তখনই তেড়ে-মেরে ছুটে এসেছে। অথচ বিজ্ঞানের কাজ সত্যের অনুসন্ধান আর তাই বিজ্ঞানের চালিকা শক্তি হচ্ছে অনুসন্ধিৎসা। ধর্মকে চ্যালেঞ্জ করা বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু মিথ্যা ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত বলেই, বিজ্ঞানের এক একটি আবিষ্কারে ধর্ম নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। ধর্মান্ধদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় ঘোরতর প্রতিক্রিয়ার।
অনিবার্য সংঘাতবিজ্ঞানের উন্মেষ ঘটে ধর্মশাসিত সমাজের মধ্য থেকে। বিজ্ঞান মাথা তুলে দাঁড়ায় ধর্মের কোলেই। নিকোলাই কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) (১০) ছিলেন একজন ক্যথলিক ধর্মযাজক। তার লেখা On the Revolutions of the Heavenly Bodies-এ প্রথম (১৫৪৩) শোনা যায় সূর্যই বিশ্বব্রহ্মান্ডের কেন্দ্রে এবং পৃথিবী তার চারপাশে ঘুরছে। (যদিও সূর্যকেন্দ্রিক ধারণার কথা শোনা গিয়েছিল আরো আগে, গ্রীক দার্শনিক পিথাগোরাস, এরিস্টারখাস প্রমুখের ধারণায়।) চার্চের সমর্থনপুষ্ট টলেমীয় পৃথিবীকেন্দ্রিক ধারণাকে এই প্রথম বিজ্ঞান সরাসরি প্রশ্নবিদ্ধ করে তুললো। কোপার্নিকাসের ধারণাও পুরোপুরি সঠিক ছিল না, তিনি ভেবেছিলেন এই ঘূর্ণনের গতিপথ বৃত্তাকার। মজার ব্যাপার হচ্ছে কোপার্নিকাস তার গ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন পোপকে। সেটা করেও বোধ হয় ছাড় পেতেন না তিনি। পৃথিবীকে এবং তার ভেতরে বসবাসকারী সৃষ্টির সেরা মানব সম্প্রয়দায়কে বিশ্বের কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত করার মহা অপরাধে তাকে হয়তো শাস্তি পেতেই হতো। যদি না বইটি যে বছর প্রকাশিত হয় সে বছরেই তিনি মারা যেতেন। কথিত আছে, যেদিন বইটা তাঁর হাতে আসে সেদিনই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সে যুগে রাষ্ট্রের বদলে চার্চ ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার উৎসস্থল। তাই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে চার্চের মধ্যেই চলতো জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা কিংবা চিন্তাভাবনা। কোপার্নিকাসের মত একজন ধর্মযাজকের অবসরে বিজ্ঞানচর্চা তাই সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে মোটেও অস্বাভাবিক কিছুই ছিল না।
মানুষের ইতিহাসে ধর্মের এবং ধর্মভিত্তিক আচার-আচরন ও চিন্তা-ভাবনার উদ্ভব হয়েছে অনেক আগে, কমপক্ষে কয়েক হাজার বছর আগে। তুলনামুলক হিসাবে বিজ্ঞান মাত্র সেদিনকার ঘটনা, বিজ্ঞানের বয়স বড়জোর চার থেকে পাঁচশ বছর। বিজ্ঞানের অনুপস্থিতিতে সব প্রশ্নের উত্তর, সব সমস্যার সমাধান ধর্মেই খোঁজা হতো। আগেকার দিনে ধর্মই ছিল বিজ্ঞানের বিকল্প। শুধু বৈজ্ঞানিক নয়, সামাজিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সব কিছুর বিধি-বিধান আইন-কানুনের উৎস ছিল ধর্ম। এখনও, এই যুগেও ধর্মাচ্ছন্ন ও ধর্মান্ধ মানুষেরা মনে করেন তাই হওয়া উচিত। কিন্তু বিজ্ঞানের ক্রম-অগ্রগতি সমস্যায় ফেলে দিয়েছে ধর্মানুসারীদের। বিজ্ঞান যতই অগ্রসর হয়েছে, ধর্ম ততই প্রতিক্রিয়াশীল ভুমিকা নিয়েছে। এই ভুমিকা এক এক যুগে এক এক রকমের, আগে ছিল মারমুখী সংঘাতের এখন অনেকটা সমন্বয়ের, সহাবস্থানের। বিজ্ঞানের সাথে যুদ্ধ ঘোষনা করে আর যে পার পাওয়া যাচ্ছে না এবং যাবেও না, ধর্মের প্রবক্তারা তা মোটামুটি বুঝে নিয়েছেন। তাই সরাসরি সংঘাতের কথা আর নয়, বরং আজকাল তাদের মুখেই সমন্বয়ের কথা শোনা যায়। লক্ষ্যণীয় যে, সত্যিকারের বিজ্ঞানমনস্ক যারা, তাদের এই ধর্ম আর বিজ্ঞানের সমন্বয় নিয়ে মাথাব্যথা নাই। আগ্রহটা সবসময়ই দেখা যায় আসছে ধর্মওয়ালাদের দিক থেকে।
২ মে, ২০০৮
ইরতিশাদ আহমদ পেশায় প্রকৌশলী। তার লেখাটি আমাদের মুক্তমনার পরবর্তী বই -‘বিজ্ঞান ও ধর্ম – সংঘাত নাকি সমন্বয়?’– প্রকাশিতব্য সংকলন-গ্রন্থের জন্য নির্বাচিত হল - মুক্তমনা সম্পাদক।