বিজ্ঞানমনস্ক ধারা ধর্মাচ্ছন্ন স্রোতে
(পর্ব-৩)
সংঘাত, সহাবস্থান, সমন্বয়–ধর্মভিত্তিক চিন্তাধারার ক্রমপশ্চাদপসরন
মানুষ ঈশ্বর শব্দটাকে অত সহজে বাদ দিতে পারে না, যত সহজে ঈশ্বরের ধারণাটাকে বাতিল করে দিতে পারে। – বার্ট্রান্ড রাসেল। (১১)
সমন্বয় কেন?
বার্ট্রান্ড রাসেলের (১৮৭২-১৯৭০) ‘ধর্ম ও বিজ্ঞানের’ (Religion and Science) যে সংস্করনটা আমার হাতে আছে, তাতে উপক্রমণিকা (introduction) লিখেছেন বিজ্ঞান-দর্শনের প্রখ্যাত এবং বিতর্কিত পন্ডিত গবেষক মাইকেল রিউস।(১২) এই উপক্রমণিকায় মাইকেল রিউস লিখেছেন, ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে সংঘাত-সমন্বয়ের চারটি রূপ দেখা যায়।
এক – যুদ্ধংদেহী, বিরোধমুলক। যখন ধর্মবাদীরা মনে করেন, বিজ্ঞানের আবিষ্কার মিথ্যা। ধর্মান্ধদের এই দলে ফেলা যায়। এরা ছয় হাজার বছর আগে ছয় দিনে এই বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্বাস করেন, আদম-হাওয়ার গল্প, নুহের প্লাবন এসব গল্পকাহিনী সত্যি বলে মানেন। এরা বিশ্বাস করতে পারেন না যে আর্মস্ট্রংরা চাঁদে গিয়েছিলেন। আমেরিকায় এরাই হচ্ছেন ‘ক্রিয়েশন’ তত্ত্বের অনুসারী।
দুই – পার্থক্যতায় বিশ্বাসী, সহাবস্থানমুলক। এরা মনে করেন যে, ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে সংঘাতের কোন কারণ নাই। কারণ দুটো সম্পূর্ন আলাদা জিনিষ। এদের কাজ-কারবার সম্পূর্ন ভিন্ন ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে। ধর্মে যেসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়, বিজ্ঞানে তা পাওয়া যাবেনা, আর বিজ্ঞানের গবেষণায় ধর্মীয় প্রশ্নের মীমাংসা হবেনা। এদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষিত, এমনকি বিজ্ঞানীরাও আছেন। এরা ‘বিশ্বাসে মিলে হরি, তর্কে বহুদূর’ এই নীতির প্রবক্তা এবং সহজে বিজ্ঞানমনষ্কদের সাথে তর্কে লিপ্ত হন না। এরা মনে করেন, বিজ্ঞানে পাওয়া যায় ‘কিভাবে হয়’ (how) প্রশ্নের উত্তর, আর ধর্মে ‘কেন হয়’ (why) প্রশ্নের। এরা আদম-হাওয়ার গল্প সত্যি কি মিথ্যা এই তর্কে যান না, কিন্তু এই গল্পের অন্তর্নিহিত শিক্ষায়, আমাদের কি করা উচিৎ এবং কেন করা উচিৎ তাতে বিশ্বাস করেন। এরা মনে করেন আমাদের স্রষ্টার প্রতি অনুগত থাকা উচিৎ এবং স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি দায়িত্বশীল থাকা উচিৎ। এদের অনেকেই ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন তত্ত্বে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন।
তিন – সংলাপে বিশ্বাসী, সমন্বয়মূলক। এরা মনে করেন ধর্ম আর বিজ্ঞানের বিষয় ভিন্ন হলেও দু’এর মধ্যে সংযোগ আছে এবং কিছু কিছু ব্যাপার ধর্ম আর বিজ্ঞান দুটোরই আওতায় পড়ে। তাই এ দু’এর মধ্যে সমন্বয় আবশ্যক। এরা ধর্মকে যুক্তির সাহায্যে গ্রহনযোগ্য করে তোলার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন। এদের অনেকেই বাইবেলীয় আজগুবি গল্পগুলির সবকটিকে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি বলে মনে করেন না; নিরন্তর চেষ্টা করেন এই গল্পগুলির পেছনের রূপকার্থ আবিষ্কার করতে এবং তা অবিশ্বাসীদের বোঝাতে। এরা একদিকে বিবর্তনতত্ত্ব স্বীকার করে নেন, অন্যদিকে একজোড়া আদি মানব-মানবীর ধারণায়ও বিশ্বাস করেন। স্বভাবতই স্ববিরোধী, চেপে ধরলে এরা দ্বিতীয় গ্রুপের ধর্মাচ্ছন্নদের মতই বলে বসেন, বিজ্ঞান কি পেরেছে ঈশ্বর নাই তা প্রমাণ করতে? কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব প্রমাণ করার দায়িত্ব যে যুক্তিশাস্ত্রের নিয়মানুসারে বিজ্ঞানের ওপর বর্তায় না, এরা তা বোঝেন না। এদের বিশ্বাস বিজ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, ধর্মই পারে সেখানে পথ দেখাতে।
চার – সম্মিলনে বিশ্বাসী, অভিন্নতামূলক, সম্পৃক্ততাবাদী। এই ধারায় যারা চিন্তা করেন তারা মনে করেন, ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে আসলে কোন দ্বন্দ নাই। বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণে এবং সাক্ষ্যপ্রমাণে ধর্মীয় মতবাদের সঠিকতাই প্রমাণিত হয়। এদের ধারনা ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যকার পার্থক্য কৃত্রিম। এরাও বিবর্তনতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পুরোপুরিই মানেন, কিন্তু এটাও মনে করেন যে, বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঈশ্বরই মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীবে পরিনত করেছেন। কিন্তু কেন করেছেন এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে এরা ব্যর্থ হন।
বলা দরকার, মাইকেল রিউস একজন সমন্বয়পন্থী, যদিও নিজেকে নাস্তিক বলে দাবী করেন। বিবর্তনতত্ত্ব পুরোপুরি মেনে নিয়েও খৃষ্টান হিসেবে জীবন যাপন করা যায় বলে তিনি মনে করেন। (১৩) তাই তিনি কোথায়ও বলেন নি, যারা কোন না কোন ভাবে ধর্মাচ্ছন্ন শুধুমাত্র তারাই এই উপরোক্ত চার গ্রুপের কোন একটিতে পড়েন। তিনি বার্ট্রান্ড রাসেলকে সংঘাতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু এটা বোঝা দরকার যে, মাইকেল রিউসরা সব বিজ্ঞানমনস্ক মানুষকেই সংঘাতপন্থী মনে করেন। আসল ব্যাপারটা হলো এই যে, সত্যিকারের বিজ্ঞানমনস্ক কোন ব্যক্তিই সমন্বয়পন্থী কিংবা সহাবস্থানপন্থী হতে পারেন না। এবং সে কারণে তারা সংঘাতপন্থীও নন। বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনায় ধর্ম বা ধর্মীয় মতবাদ প্রাসঙ্গিক কিংবা প্রয়োজনীয় নয়। এ প্রসঙ্গে ফরাসী গণিতজ্ঞ ও জোতির্বিদ পিয়ের-সাইমন ল্যাপলাসের (১৭৪৯-১৮২৭) কথা প্রণিধানযোগ্য। জোতির্বিদ্যার ওপরে ল্যাপলাসের লেখা বইটা দেখে নেপোলিয়ন নাকি বলেছিলেন, “আপনার লেখা বইটা খুবই ভালো, কিন্তু ঈশ্বরের কোন উল্লেখ দেখছিনা কেন?’ ল্যাপলাস নির্বিকারে উত্তর দিয়েছিলেন, “স্যার, আমার ওই অনুমানটার (hypothesis) কোন প্রয়োজন ছিল না”।
(মাইকেল রিউসের মতে, ডারউইন নাকি প্যালি-বর্নিত ডিজাইন খুঁজতে গিয়ে বিবর্তনতত্ত্ব আবিষ্কার করে বসেন। মাইকেল রিউস আরো মনে করেন যে, ডিজাইনতত্ত্ব ছাড়া নাকি বিবর্তনতত্তের আবিষ্কার সম্ভব হতো না। বিবর্তনবাদীদের এইজন্য নাকি প্যালির ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন তত্ত্বের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। অদ্ভুত যুক্তি বটে! রাজতন্ত্রের হাত থেকে ভারতের মুক্তির জন্য এবং ভারতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতবাসীকে যেন বলা হচ্ছে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে!)
ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে সংঘাত-সমন্বয়ের এই চার অবস্থানের বর্ণনা দেয়ার পর খুবই চতুরতার সাথে রিউস এই উপক্রমণিকাতেই লিখেছেন যে, তিনি বলছেন না এই চারটির মধ্যে কোনটি সঠিক এবং কোনগুলি বেঠিক। তিনি রাসেলের বইয়ের পাঠকদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন এই বলে যে এই সিদ্ধান্ত “আপনাদের পাঠকদের”। আবার এও বলছেন যে, রাসেলের এই বইটিতে বিজ্ঞানমনস্করা (তাঁর মতে, বিজ্ঞানবাদী সংঘাতপন্থীরা) পাবেন তাদের অবস্থানের পক্ষে খুবই পরিষ্কার এবং জোরালো যুক্তি। রিউস সমন্বয়পন্থীদেরও (মানে, ধর্মাচ্ছন্নদেরও) বলছেন এই বইটি পড়তে, বিপক্ষের যুক্তি সম্পর্কে জানার জন্য, “নিজের অবস্থানের বিপক্ষে সবচেয়ে ধারালো যুক্তি যদি শুনতে চান, পড়ুন এই বইটি, বিজ্ঞানের পক্ষে এবং ধর্মের বিরুদ্ধে এমন যুক্তিপূর্ন আলোচনা আর কোথায়ও পাবেন না; তবে সাবধান, আপনার মত পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে”। রাসেলের ‘রিলিজিয়ন এন্ড সায়েন্স’-এর যে কোন পাঠকই মানবেন, রিউসের আশংকা অমুলক নয়।
রিউসের ব্যক্তিগত মতামত যাই হোক না কেন, এটা ঠিক যে, পৃথিবীতে ধর্মাচ্ছন্ন মানুষের সংখ্যাই বেশী এবং তারা রিউস-বর্ণিত চার গ্রুপের কোন একটিতে পড়েন।
প্রথম দলের (ধর্মাচ্ছন্ন সংঘাতবাদী) প্রভাব প্রধানত অশিক্ষিত মানুষের ওপর। কিন্ত দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ দলে অনেক শিক্ষিত লোকজন আছেন। আমরা এঁদেরকেই দেখি প্রতিদিন আমাদের চারপাশে। বিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরের জন্য এরা এই যুগে আর ধর্মের দ্বারস্থ হন না। কিন্তু নৈতিকতা আর মূল্যবোধের শিক্ষার জন্য ধর্মের ওপর নির্ভর করেন।
ধর্মের পিছু হটা
বিজ্ঞানের উন্মেষকালে ধর্মের পরাক্রম ছিল প্রবল। কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব তাই ছিল বিপ্লবাত্মক। ধর্মবাদীদের মধ্যে শুরু হলো ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার। বলা হলো, সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীকে এত জটিল করে বানাননি; বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবকিছুই নিখুঁত এবং সুবিন্যস্ত; ঈশ্বর পৃথিবীকে এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে বসিয়ে দিয়েছেন কারণ পৃথিবী হচ্ছে মানুষের বাসভূমি; সৃষ্টিকর্তা সবকিছু মানুষের প্রয়োজনেই সৃষ্টি করেছেন। (ধর্মবাদীদের স্ববিরোধিতা এখানে লক্ষ্যনীয়; এরা আগে জটিলতাকে অস্বীকার করতে চেয়েছেন, পরে জটিলতাকেই ‘ডিজাইনের প্রমাণ’ বলে দাবী করেছেন।)
পোপকে উৎসর্গ করার পরেও কোপার্নিকাসের বইয়ের প্রকাশক ওসিয়ান্দরের স্বস্তি ছিলনা। তিনি (সম্ভবত কোপার্নিকাসের অমতে) বইয়ের ভুমিকায় লিখে দেন, এই গ্রন্থে বর্ণিত পৃথিবীর গতি-তত্ত্বটি একটি অনুমান বিশেষ, একে প্রমাণিত সত্য হিসেবে দাবী করা হচ্ছেনা। (১৪) কোপার্নিকাস ও তার প্রকাশককে কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছিল ধর্মীয় অনুশাসনের (স্যাঙ্কশন) ভয়ে। পরে রেনি ডেকার্টে (১৫৯৬-১৬৫০) কোপার্নিকাসের তত্তের প্রতি মৃদু সমর্থন জানিয়েছিলেন, তাও ভয়ে ভয়ে। জিওদার্নো ব্রুনোকে (১৫৪৮-১৬০০) ক্যাথলিক চার্চের আদেশে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল ১৬০০ সালে। গ্যালিলিও গ্যালিলিকে (১৫৬৪-১৬৪২) শাস্তিভোগ করতে হয়েছিল আমরণ।
কিন্তু বিজ্ঞানের জয়যাত্রা থেমে থাকেনি। থেমে যাননি নিউটন, ডারউইন, এবং আইনস্টাইন। তাঁরা এবং তাঁদের সহযাত্রীরা বিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সত্য অনুসন্ধানের একমাত্র পন্থা হিসেবে। ধর্ম ক্রমাগত হয়েছে কোণঠাসা, ধর্মবাদীদের ক্রমশ পিছাতে হয়েছে, সংশোধন (এডজাস্ট) করতে হয়েছে নিজেদের অবস্থান। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে ধর্মের দাপটে বিজ্ঞানের অবস্থান ছিল আত্মরক্ষামুলক, আর আজ ধর্মবাদীরাই বিচলিত, বিজ্ঞান ধর্মের পরিসীমায় নাক গলাচ্ছে বলে চিন্তিত। আগে বলা হতো, ধর্মের কোন আওতা বা বলয় নাই, ধর্ম সর্বব্যাপী। আর আজ সমন্বয়বাদীদের মুখে শোনা যায় ‘স্বতন্ত্র বলয়ে’র কথা।
স্টিফেন জে গুল্ডের “স্বতন্ত্র বলয়” বা Nonoverlapping Magisteria তত্ত্ব (১৫) যা NOMA নামে খ্যাতি পেয়েছে, তার মূল কথা হচ্ছে বিজ্ঞান-সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর ধর্ম দিতে পারে না, তাই ধর্মের উচিৎ বিজ্ঞানের আওতার বাইরে থাকা; একই যুক্তিতে বিজ্ঞানেরও উচিৎ নয়, ধর্মের বলয়ে নাক গলানো। দুই বিবদমান পক্ষকে সংঘাত থেকে বিরত রাখার যেন এক প্রাণান্তকর চেষ্টা! গুল্ডের মতে এটাই হচ্ছে সম্মানজনক পন্থা; তাঁর ভাষায় শুধু কূটনৈতিক নয়, নৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিবেচনায়ও।
রিচার্ড ডকিন্স স্বতন্ত্র বলয় তত্ত্বের (Nonoverlapping Magisteria) বিরুদ্ধে জোরালো যুক্তি দিয়েছেন।(১৬) ডকিন্স সব ধর্মীয় বিশ্বাসকে বিজ্ঞানের আওতার বাইরে রাখার চেষ্টাকে অসৎ মনোবৃত্তির পরিচায়ক মনে করেছেন। তাঁর ভাষায়, ধর্মে যে সমস্ত অলৌকিক গল্প-কাহিনী দিয়ে সাধারণ মানুষকে বোকা বানানো হয়, সেই গল্পগুলির মধ্যে ব্যবহার করা হয় বিজ্ঞানের উপকরণ; আর বিজ্ঞান যখন এই সব গাঁজাখুরি গল্প-কাহিনীর সত্যতা এবং সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তখনই বলা হয়, বিজ্ঞান ধর্মে নাক গলাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে স্বতন্ত্র বলয়ের প্রবক্তাদের মনে হয় শান্তিকামী, কিন্তু মিথ্যাকে মেনে নিয়ে যে শান্তি, তা কাম্য হওয়া উচিৎ নয়। দূর্ভাগ্যের ব্যাপার, অনেক নাস্তিক বিজ্ঞানীও শুধুমাত্র সমন্বয়ের খাতিরে ধর্মবাদীদের সাথে আপোষ করতে প্রস্তুত। স্টিফেন গুল্ড এবং মাইকেল রিউস হচ্ছেন এই দলের বিজ্ঞানী। Nonoverlapping Magisteria হচ্ছে তাঁদের এই ধরনের মানসিকতারই ফলশ্রুতি। এঁরা বিজ্ঞানী হলেও বিভ্রান্তির শিকার এবং বিপজ্জনক ভাবে ধর্মাচ্ছন্ন। তানবীরা তালুকদার ডকিন্সের প্রবন্ধটার বাংলা অনুবাদ করেছেন ‘মুক্তমনা’য়। (১৭) উৎসাহী পাঠকেরা পড়ে দেখতে পারেন।
বিজ্ঞানমনস্ক মানুষেরা বিজ্ঞানকে কখনোই ধর্ম বানাতে চাননা, কিন্তু সমন্বয়পন্থী ধর্মাচ্ছন্নরা ধর্মকে সবসময়েই বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাই ধর্ম আর বিজ্ঞানের দ্বন্দ নিয়ে বিজ্ঞানমনষ্করা খুব একটা বিচলিত নন, বরং ধর্মাচ্ছন্নদেরই এ নিয়ে বেশী হইচই করতে দেখা যায়। এই দু’এর মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজনও ধর্মের প্রবক্তারাই অনুভব করেন বেশী। ধর্মবাদীরাই ধর্মকে বিজ্ঞানের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, বিজ্ঞানমনস্করা নয়। রাসেলের ভাষায়, “বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষেরা মানে না, গুরুত্বপূর্ণ কিংবা কর্তৃত্বসম্পন্ন কেউ বলেছে বলেই কোন কিছু মেনে নিতে হবে – বরং ঠিক উল্টোটা, সাক্ষ্যপ্রমাণ ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে যা জানা যায় শুধুমাত্র তাকেই তারা সত্য বলে মেনে নেয়। এই ‘নতুন’ পদ্ধতির অভুতপূর্ব সাফল্য – তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক উভয়বিধ – ধর্মবাদীদের বাধ্য করে ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে”।(১৮)
সে যুগে ধর্ম বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে বাধা ছিল, আজকাল তা আর সেরকম ভাবে নাই। এখন ধর্মবাদীরা ভীত বিজ্ঞান ধর্মের বিকাশে না বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিজ্ঞানকে তাই ধর্মের বলয় থেকে দূরে রাখার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এটা নিসন্দেহে বিজ্ঞানের অপ্রতিহত অগ্রযাত্রার, আর ধর্মের ক্রমপশ্চাদপসরনের নিদর্শন। সংঘাত ধর্মবাদীরাই সৃষ্টি করেছে, বিজ্ঞান নয়। সমন্বয়ও ধর্মবাদীদেরই মস্তিষ্কপ্রসুত, বিজ্ঞানের প্রয়োজন নাই সমন্বয়ের।
ধর্ম যেখানে প্রতিনিয়তই অবস্থান পরিবর্তন করছে বিজ্ঞানকে জায়গা করে দিতে, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা সেখানে অপ্রতিরোধ্য, অপ্রতিহত। বিজ্ঞানের কাজই হচ্ছে সত্যের সন্ধানে এগিয়ে যাওয়া, নিত্যই নতুন জ্ঞানের পেছনে ছোটা।
৮ মে, ২০০৮
ইরতিশাদ আহমদ পেশায় প্রকৌশলী। তার লেখাটি আমাদের মুক্তমনার পরবর্তী বই -‘বিজ্ঞান ও ধর্ম – সংঘাত নাকি সমন্বয়?’– প্রকাশিতব্য সংকলন-গ্রন্থের জন্য নির্বাচিত হল - মুক্তমনা সম্পাদক।