বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ১৬

বাসুন,

এই মাসে তোর জন্মদিন সোনা. তুই জানিস সেকথা, তাই আমি যখন এই লেখা লিখছি তখন পাশের ঘরে তুই জন্মদিনের জিনিসগুলো বিছিয়ে বসে খেলছিসসত্যি বলতে কি জানিস সোনা, আজকে থেকে ঠিক আট বছর আগে যেদিন তুই জন্মেছিলি সেদিন কিন্তু আমার স্বপ্নেও ছিলো না যে, আমর জীবনে এমন একটা দিন আসবে যখন তোকে নিয়ে আমার একা সময় কাটাতে হবে. কেন বাবু জীবন এত বিচিত্র, সবার জীবনই তাই? আজ সারাদিন ধরে আমার ভীষন মন খারাপ ছিলো বাবু, কিন্তু এই মাত্র বাংলাদেশের পত্রিকায় ছোট একটা লেখা পড়ে মনের ভীতরটা আত্ববিশ্বাসে ভরে উঠলো। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন মানুষের সাফল্যর ৭ টি সুত্রকিন্তু কোথাও তিনি মানুষকে মেধাবী হতে বলেননি, একবারও না আমি খুব বেশী এভ্যারেজ মেধার মানুষ বাবু, খুবই বেশী, এই কষ্টটা আমাকে ভীষন পোড়ায়। কিন্তু তারপরও আমি যখন মানুষের  জীবনের খুব গভীরটা বোঝার চেষ্টা করি তখন মনে হয় এই তো জীবন, কত দেখার, কত বোঝার আছে। কেন এত তাড়াতাড়ি হতাশ হই আমরা ? বাবু, গতকাল  গিয়েছিলাম একটা ইংরেজী উচ্চারন শেখার কর্মশালায়, সেখানে পরিচয়  হলো এনস্যা  নামে এক মধ্যবয়সী মহিলার সাথে। কানাডাতে আছে প্রায় ২৭ বছর কিন্তু সংসারের বাস্তবতার কারনে এতদিনেও চাকরি ও যোগ্যতাকে  নিয়ে ভাবার সময় পায়নি এনস্যা। এখন ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, ও মনে করছে এবার নিজেকে দাড় করানো দরকার। তাই এনস্যা ওর অবসর সময়ে ইংরেজী শেখার চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রতিদিন ইয়োগা করে, ট্রেড মিল করে, সংসার সামলায় আবার  নিজেকেও প্রস্তুত করার কথা ভাবে। তাহলে আমি কেন হতাশ হয়ে থাকি বাবু? শুধু কি বাংলাদেশের মতো একটা স্বপ্ল উন্নত দেশ থেকে আসার কারনেই  আমাদের মানসিক শক্তি কম বা আমরা সহজেই হাল ছেড়ে দেই? নিজেকে আরো ভালো বোঝানোর জন্যই আমি জীবনের শিকড়ে যেতে চাই। পরিচয় হলো হেইতি থেকে আসা ৩০ বছরের তরতাজা ডাক্তার ছেলে ওলফ্রেডোর সাথে, রাতের বেলা কাজ করে ফ্যক্টরীতে আর দিনের বেলা নিজেকে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে ও। ইংরেজী শেখার পর ও ডাক্তারী পড়বে, ওলফ্রেডোর মতে—”কানাডাতে নিজেকে গড়ে তোলার সব সুযোগগুলো ও কাজে লাগাবেওর কথা শুনতে শুনতে আমার বাংলাদেশী ডাক্তার মেয়ে মুনার কথা মনে পড়ে গেলো, ৬ বছর আগে  টরোন্টোতে এসছিলো মুনা, আমার সাথে পরিচয় হবার পর কি অবলীলায় বলল , ”কি বলো লুনা তুমি? ছোটবেলা থেকে বাবা/মা ডাক্তারী পড়ানোর জন্য আমাকে জোর করেছিলো বলে  ডাক্তারী পড়েছি, বিয়ের পর সহজেই চাকরি পেয়েছিলাম বলে ৫ বছর কাজও করেছি,এখন টরোন্টোতে এসে শুনি আমাকে এখানে ডাক্তারী করতে হলে আরো ১০ বছর পড়তে হবে। পাগল নাকি তুমি? আবার পড়াশুনা, অসম্বব তার চেয়ে  বাকী জীবন বসে থাকবোআমি সেদিন মুনাকে বলার কিছু পাইনি কারন আমি জানতাম বাংলাদেশে একটি মেয়েকে ডাক্তারী পড়াতে শুধু সরকারেরই খরচ হয় ৩৫ লাখ টাকা আর সেই মেয়ের নিজের মেধা বাবা/ মায়ের শ্রম তো আছেই , আজকে মুনা শুধু ডাল আর ভাত রান্না করে জীবন পার করছে যা করার জন্য অক্ষরজ্ঞান না থাকলেও চলে পাশাপাশি  ওলফ্রেডো আর এনস্যাকে  দেখে আমি নিজের ভিতর শক্তি খুজে ফিরিঅবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি ৫৮ বছর বয়সী ম্যালেনিয়ার সাথে পরিচিত হয়ে। মূল বাড়ি ইরানে, কিন্তু কানাডায় আসার পর সেই একই যুদ্ধ, ইংরেজী শেখা দরকার তাই ম্যালেনিয়া গুটি গুটি পায়ে বাড়ির বাইরে আসে। সবার সাথে মিশে  নিজে আনন্দময় সময় কাটায় কি দার্শনিকভাবে ম্যালেনিয়া আমাকে বলে, জানো লুনা, তুমি চাইলেও সময় চলে যাবে না চাইলেও  সময় যাবে তাহলে আর শুধু শুধু ঘরের ভিতর বসে আকাশে তারা গুনবো কেন বলো  ? বয়স হয়েছে বলে তো আর আমাকে কেউ অপমান করছে না তাহলে শিখতে অসুবিধা কোথায়?” কি আর্শ্চষ বাবু, আমি এসব কথা শুনতে শুনতে ফিরে যাই আমার বাবার জীবনে যিনি বাংলাদেশের মাগুরা জেলার এক অজ পাড়াগায়ে জন্মেছিলেন। তোর নানাভাই কে আমার দাদা মানে তোর বড়আব্বা বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মেট্রীক পরিক্ষার পর থেকে। কিন্তু আমার বাবা নিজের জীবন গড়ে তুলেছিলেন কঠোর একাগ্রতায়কখনই আমার বাবা মেধাবী মানুষ ছিলেন না, কিন্তু পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন বাবা  পিএইচডির অফার পেয়েছিলেন আমরা চারবোন হবার পর। তারপরও আব্বু পড়া শেষ করেছিলেন এবং যেদিন বাবা গোল্ডমেডেল পেয়েছিলেন সেদিন বাবার পরের পজিশন এ সহপাঠী নাকি বলেছিলো জলিল,সোনার মেডেলটা তুমি জিতে নিল, বাবা বলেছিলেন,আমার তো  চারমেয়ে আমার আরো তিনটে দরকার সত্যি  কথা কি জানিস বাবু, মেডেল সত্যি বাবা আমাদেরকে দিয়েছিলেন (এই ফাকে তোকে বলি বাবু, তোর নানী আপু আমাদের চারবোনকেই বলেছিলো যে প্রথম পিএইচডি করবে সেই মেডেলটা পাবে)  কিন্তু সেটা সোনার চেয়েও দামী যার নাম একাগ্রতা এই যে আমি তোকে নিয়ে দীর্ঘ পথ চলি, আমার হতাশা আমাকে ঘিরে ধরার আগেই আমি ফিরে যাই অতীতে। আমার নিজেরই ফেলে আসা জীবনে যেখানে আরো কঠিন সময়কে পার করার কথা লেখা আছেবাবু, তোর জন্মদিন, আমি  ছোটবেলায় অল্পকিছুদিন নানাবাড়িতে হারিকেনের আলোয় অক্ষর শিখেছিলাম। আমার বাবা এম এ পর্যন্ত পড়েছিলেন কেরোসিন এর আলোতে। আর আজ তুই আমার ঠিক পাশেই বসে পড়ছিস পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশে। দেখ কেমন করে প্রজন্ম এগিয়ে যায়, তাই না বাসুন? আজ তোর জন্মদিন সোনা, জীবনে পথ চলতে গিয়ে শুধু হাল ছেড়ে দিস না সোনা , তোর ওই মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমি যেমন প্রতিদিন জীবন জয়ের স্বপ্ন দেখি একদিন তুই ও আমার রিলে রেসটা নিয়ে আত্ববিশ্বাসে পথ চলবি শুধু এটুকুই চাই সোনা জন্মদিনে তোর কপালে একটা চুমু  বাবু

তোর মা,

২০ শে নভেম্বর, ২০০৭

Email:[email protected]

পর্ব ১                                                                             পর্ব ১