বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ১৯

বাসুন,

বাবু, এটা ডিসেম্বর মাস, তিনবছর আগে এই মাসের ২০ তারিখে আমি দেশ ছেড়েছিলাম। একমাত্র মানুষই বুঝি তার অর্জন আর প্রাপ্তি দেখতে চায় আর সেকারনেই নিজেই নিজের অতীত হাতড়ায়আমি সকাল থেকে নিজের মধ্যে নিজেই ঘুরপাক খাচ্ছি, কোথায় আমার শুরু, কোথায় আমার শেষ? হঠা আমার আর তোর ছোট লিভিং রুমের কোনায় যে বুকশেলফ আছে সেখান থেকে তুলে নিলাম জেন্ডার কোষ। দেশ থেকে চলে আসার পরের বছর এই বইটা প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় এরকম বই এটাই প্রথমএখানে ফসটিনা পেরেরার (আইনজীবি, আইন ও সালিস কেন্দ্র, ঢাকা) লিখিত মানুষনামে একটা ছোট পাদটিকা চোখে পড়ল তুই বড় হয়ে আমার লেখা পড়বি আর জানবি তোর মা সারাদিন কত  কি ভাবতো, কেমন করে সময় পার করতো তাই না বাসুন? জানিস বাবু, আমার দেশ ছেড়ে আসার অনেকগুলো কারনের ভিতর একটা হচ্ছে, বাংলাদেশে আমার নিজের জীবনটা আমি নিজে যাপন করতে পারতাম না ব্যক্তিগত জীবনের কথা বাদই দিলাম অফিস আদালতে বা একেবারেই অপরিচিত মানুষও যখন শুনতো আমি তোকে নিয়ে একা থাকি, আমি স্বামীর সাথে থাকি না তখনো তাদের চেহারা, কথাবার্তা কেমন পাল্টে যেত। কিন্তু বাবু গত তিন বছরে কানাডাতে কোন কাজের জন্যই আমাকে ব্যক্তিগত কোন বিযয় নিয়ে কথা বলতে হয়নি। এমনকি যদি তোর বাবার নাম লেখার জন্য আমাকে কোন প্রশ্ন কখনো করা হতো তাহলেও প্রশ্নটা করতো ঠিক এইভাবে কুড ইউ প্লিজ টেল আস ইয়োর চাইল্ডস বায়ালোজিক্যাল ফাদারস নেম?” অথচ এই আমাকেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাক এ চাকরির ইন্টারভিউ দেবার সময় একজন  হাই অফিসিয়াল এর কাছে মোট ৪০ মিনিটের ইন্টারভিউতে ২৫ মিনিট ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিলোনারী ও মানুষ এই আলোচনা অনেকটাই মুখ্য নারীকে কিভাবে বিবেচনা করা হয় সমাজ কাঠামোতেনিচের এই ছোট নোটটা তাই টাইপ করলাম আজকে সকালে বসে বসে। 

{মানুষ:খ্রিস্টান  নারীবাদীরা র্ধমীয় সাহিত্যে/ধর্মগ্রন্থে  ব্যবহৃত  শব্দ বিশেষের ক্ষেত্রে  আপত্তি জানিয়ে আসছেন তারা মনে করেন যে, এ ধরনের  শব্দগুলো  নারীকে পুরুষের  অধস্তন একটি অবস্থানে স্থাপন করে এবং মানুষ  হিসেবে  নারীর মর্যদাকে ক্ষুন্ন করে এবং ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্র জীবন পর্যন্ত  সকল পযার্য়ে একটি প্রভাব বিস্তার করে, যার প্রতিফলন দেখা যায নারীর প্রতি অব্যাহত সহিংসতায় এবং নারী- অসমতায় বাইবেলে মানুষ বলতে  সাধানরভাবে মানবজাতিকে না বুঝিয়ে শুধু পুরুষকে বোঝানো হচ্ছে, ইশ্বর নিদের্শ দিচ্ছেন মানুষকে, কথা বলছেন মানুষের সংগে, এই মানুষ  সন্দেহাতীতভাবেই পুরুষযেমন প্রভু পরমেশ্বর বললেন, মানুষের পক্ষে একা থাকা ভালো নয়: তার জন্য আমি তার মতো একজন সহায়ক নিমার্ন করবো আদিপুস্তক ২:১৮/মানুষ থেকে তুলে নেওয়া সেই হাড় পাজর দিয়ে প্রভু পরমেশ্বর এক নারী গড়লেন  ও তাকে মানুষের কাছে আনলেনআর মানুষ বলল, এই হলো  আমার হাড়ের হাড় /ও আমার মাংশের মাংশ /এর নাম নারী হবে /কেননা নর থেকেই তাকে তুলে নেয়া হয়েছে আদিপুস্তক ২:২২,২৩/এখানে লক্ষনীয়, নারীকে যে শুধু পুরুষের সহায়ক বা অধস্তন হিসেবেই  বর্ননা করা হচ্ছে, তা নয়, বরং নারী যে মানুষ এই প্রাথমিক পরিচয় বা স্বৃকীতি থেকেই তাকে বঞ্চিত করা হচ্ছেএমনকি কোথাও কোথাও নারীকে সস্পত্তি ও পশুপাখির সমান পযার্য়ে ফেলা হয়েছে যা খুবই অমর্যদাকর ও অমানবিকনারীর মর্যাদা ক্ষুন্ন করার পাশাপাশি  এ ধরনের বিধানগুলো সমাজের মনোজগতে মারাত্বক প্রভাব ফেলে যা নারী, পুরুষ  উভয়ের অবচেতনমনেই এরকম ধারনাকে বদ্ধমূল করে দেয় যে নারী দুর্বল, অধম ও পুরুষের কর্তৃত্বাধীনযেমন,--” তোমার প্রতিবেশির  স্ত্রী .তার দাস দাসী, তার বলদ গাধা, তার কোন কিছুরই প্রতি লোভ করবে না যাত্রাপুস্তক ২০:১৭ আবার  এমনকিছু বিধানও  রয়েছে  যা নারীপুরুষের সমমর্যাদার ইংগিত বহন করে যেমন পরমেশ্বর তার নিজের প্রতিমুর্তিতে মানুষকে সৃষ্ঠি করলেন, পরমেশ্বররই প্রতিমুতির্তে তাকে সৃষ্টি করলেন, পুরুষ ও নারী করে তাদের সৃষ্ঠি করলেন আদিপুস্তক ১:২৭কিন্তু সমতার ইংগিতবাহক এই বানীগুলো সংখ্যায় এর চেয়ে কয়েকগুন বেশি বৈষম্যমূলক  উক্তির নীচে চাপা পড়েছে সুত্র:পবিত্র বাইবেল (জুবীলিবাইবেল), সাধু বেনেডিক্ট মঠের অনুবাদ, বাংলাদেশ ক্যথলিক বিশপ সম্মিলনী, ১৯৯৯ জেন্ডার বিশ্বকোষ (দ্বিতীয় খন্ড প --হ )  সেলিনা হোসেন ও মাসুদুজ্জামান সস্পাদিত, প্রথম প্রকাশ,ফেবরুয়ারী ২০০৬)

বাবু, জীবনের পথ চলতে গিয়ে আমি যতবার বাধা পেয়েছি ততবারই অতিক্রম করার পথ খুজেঁছি ---  সব কি পেরেছি? ইতিহাস তৈরী হয় চলার পথের গল্প থেকে, যদি মানুষ থেমে যেতো  তাহলে পথ কি আসতো? আজকে ফসটিনা যেমন সমতার কথা ভাবছেন একদিন আমার পুর্বপুরুষের নারীরাও শুধু মাথা তুলে দাড়াবার কথা ভেবেছিলেন আর সেই পথ ধরেই বিশ্বের যে কোনখানেই হোক তোকে নিয়ে যে আমি মাথা উঁচু করে সমান ভাবে বাঁচতে পারি এই বিশ্বাসই তো শক্তিশালী করে আমার পথকেনতুন বছর আরো গতিশীল হবে, নারী আরো আরো আরো সমালোচনার ঝড় তুলবে, তবেই না পথ প্রশস্ত হবেনতুন বছরে তুই আরো একটু বড় হয়েছিস সোনা, আরো একটু গভীর করে মা ডাকিস আমাকে। তোকে নতুন দিনের আদর

তোর মা,

২১ ডিসেম্বর, ২০০৭

Email:[email protected]

পর্ব ১                                                                           পর্ব ২০